কূটনৈতিক প্রতিবেদক’
নির্বাচনের পর মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের লেখা চিঠির জবাব দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিলের দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক জ্যেষ্ঠ পরিচালক রিয়ার অ্যাডমিরাল এইলিন লুবাখারের নেতৃত্বে মার্কিন প্রতিনিধিদলের ঢাকা সফরে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে ওই চিঠির অনুলিপি হস্তান্তর করা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মুহাম্মদ ইমরান প্রধানমন্ত্রীর লেখা চিঠির মূল কপি হোয়াইট হাউসে পৌঁছে দেবেন।
এদিকে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর প্রথমবারের মতো ঢাকা সফর করা ওই প্রতিনিধিদল বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক নতুন করে শুরু করার বার্তা দিয়েছে।
বাংলাদেশে নতুন সরকারও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক নতুন করে শুরু করার আগ্রহ দেখিয়েছে। এইলিন লুবাখারের নেতৃত্বে প্রতিনিধিদলে যুক্তরাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থার (ইউএসএআইডি) সহকারী প্রশাসক মাইকেল শিফার এবং পররাষ্ট্র দপ্তরের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক ডেপুটি অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি আফরিন আখতারও ছিলেন।
সফরের প্রথম দিন বৈঠকে মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস উপস্থিত ছিলেন, দ্বিতীয় দিনের বৈঠকগুলোতে ছিলেন না। মার্কিন প্রতিনিধিদলের সফরের মধ্যেই তিনি বিদেশ সফরে যান বলে জানা গেছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানিয়েছে, রবিবার বৈঠকগুলোতে পিটার হাস থাকতে পারবেন না এটি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে আগেই জানানো হয়েছিল। বৈঠকগুলোতে যুক্তরাষ্ট্রের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রদূত হেলেন লাফেইভ উপস্থিত ছিলেন।
মার্কিন প্রতিনিধিদল তাদের সফরের দ্বিতীয় দিন গত রবিবার পররাষ্ট্রসচিব মাসুদ বিন মোমেনের সঙ্গে বৈঠক করেন। এ ছাড়া পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবং প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন।
বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মুহাম্মদ ইমরান এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উত্তর আমেরিকা অঞ্চলের মহাপরিচালক খন্দকার মাসুদুল আলমসহ মন্ত্রণালয়ের অন্য কর্মকর্তারা এ সময় উপস্থিত ছিলেন।
বৈঠক ও সাক্ষাত্গুলোতে বিদ্যমান সম্পর্ককে আরো গভীর করার জন্য নতুন পথ অন্বেষণকে কেন্দ্র করে আলোচনা হয়। বৈঠকে অর্থনৈতিক সহযোগিতা, বাণিজ্য ও বিনিয়োগ, রোহিঙ্গা মানবিক সহায়তা, জলবায়ু পরিবর্তন ও জ্বালানি খাতের ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়। দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য ও বিনিয়োগ বৃদ্ধি, নিরাপত্তা সহযোগিতা, শ্রম পরিবেশ উন্নয়ন, জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় ইউএসএইডের সহযোগিতা আলোচনায় স্থান পায়।
বৈঠকগুলোতে বাংলাদেশ শান্তির পক্ষে এবং যেকোনো ধরনের যুদ্ধের বিরুদ্ধে দৃঢ় অবস্থান পুনর্ব্যক্ত করে।
ফিলিস্তিনের গাজায় স্থায়ী যুদ্ধবিরতির বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রকে উদ্যোগ নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে বাংলাদেশ। বৈঠকে আলোচনা হয় ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ, যুক্তরাষ্ট্র থেকে বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত খুনি রাশেদ চৌধুরীকে প্রত্যর্পণ ও র্যাবের ওপর থেকে যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার বিষয়েও। বাংলাদেশ র্যাবের ওপর থেকে মার্কিন নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের আহ্বান জানিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র এ ক্ষেত্রে র্যাবের জন্য পাঁচটি পর্যবেক্ষণ দেবে।
এর আগে গত মাসে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে অবাধ ও সুষ্ঠু না বললেও বাংলাদেশের সঙ্গে কাজ চালিয়ে যাওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বাংলাদেশের অর্থনৈতিক লক্ষ্য অর্জনে একসঙ্গে কাজ করার আগ্রহ প্রকাশ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে চিঠি দেন। তিনি একটি অবাধ ও উন্মুক্ত ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলের জন্য অভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গিতে বাংলাদেশের সঙ্গে অংশীদার হওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করেন।
যুক্তরাষ্ট্র-বাংলাদেশ অংশীদারির পরবর্তী অধ্যায়ে প্রবেশ করতে যাওয়া বিষয়ে চিঠিতে বাইডেন লিখেছিলেন, আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক নিরাপত্তা, অর্থনৈতিক উন্নয়ন, জলবায়ু পরিবর্তন ও জ্বালানি, বৈশ্বিক স্বাস্থ্য, মানবিক সহায়তা বিশেষ করে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জন্য একসঙ্গে কাজ অব্যাহত রাখতে তাঁর প্রশাসনের আন্তরিক আকাঙ্ক্ষার কথা তিনি জানাতে চান।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলেছেন, বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক কিভাবে আরো গভীর করা যায় সে বিষয়ে বৈঠকে আলোচনা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনকে একমাত্র সমাধান হিসেবে বিবেচনা করেছে। যুক্তরাষ্ট্র চায়, রোহিঙ্গারা সসম্মানে নিজ দেশে ফিরে যাক। সেই সঙ্গে তাদের সাময়িক আশ্রয় দিয়ে বাংলাদেশ যে উদারতা দেখিয়েছে তার ভূয়সী প্রশংসা করেছেন মার্কিন প্রতিনিধিরা।
রাশেদ চৌধুরীকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠানো প্রসঙ্গে মার্কিন প্রতিনিধিরা বলেছেন, তাঁদের বিচার বিভাগ বিষয়টি দেখছে।
মার্কিন প্রতিনিধিদল পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়কমন্ত্রী সাবের হোসেন চৌধুরীর সঙ্গেও বৈঠক করেন।
ডিএফপিতে যোগ দেওয়ার শর্ত জানাবে যুক্তরাষ্ট্র
এদিকে মার্কিন প্রতিনিধিদল গত রবিবার রাতে গুলশানে প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানের বাসায় নৈশ ভোজ ও বৈঠকে অংশ নেন। নৈশ ভোজ শেষে সালমান এফ রহমান সাংবাদিকদের বলেন, বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে সম্পর্কের নতুন অধ্যায় শুরু করতে চায় যুক্তরাষ্ট্র। সেই সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য ও বিনিয়োগ বৃদ্ধি, নিরাপত্তা সহযোগিতা, শ্রম পরিবেশ উন্নয়ন ও জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় বাংলাদেশের সঙ্গে কাজ করতে চায় দেশটি।
সংসদ নির্বাচন নিয়ে বৈঠকে কোনো আলোচনা হয়েছে কি না—সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে উপদেষ্টা জানান, ‘নির্বাচন এখন পেছনের ঘটনা। সেটা নিয়ে তারা কোনো কথা বলেনি আমরাও বলিনি। বরং সামনের দিনগুলোতে কিভাবে দুই দেশের সম্পর্ককে আরো গভীর করা যায় সেসব বিষয় নিয়েই আলোচনা হয়েছে।’
বৈঠকে মার্কিন প্রতিনিধিদল মিয়ানমার পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে উল্লেখ করে সালমান এফ রহমান বলেন, ‘মিয়ানমারের বর্তমান পরিস্থিতির ওপর তারা নজর রাখছে। সেই সঙ্গে আমাদেরকেও নজর রাখতে বলেছে।’
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র আমাদের তাদের ডেভেলপমেন্ট ফাইন্যান্স প্রগ্রামে (ডিএফপি) যুক্ত করতে চায়। এর জন্য তারা কয়েকটা শর্তের কথা বলেছে। এগুলো শিগগির জানাবে। আমরা কী কী শর্ত জানাতে বলেছি। এ ছাড়া তাদের সঙ্গে চলমান প্রকল্প অব্যাহত থাকবে।’
নাগরিক অধিকার চর্চার সুযোগ নিয়ে প্রশ্ন
এদিকে সংসদ নির্বাচনের পর বাংলাদেশে রাজনৈতিক অধিকার ও নাগরিক অধিকার চর্চার সুযোগ কেমন, যুক্তরাষ্ট্র তা জানতে চেয়েছে। নাগরিক সমাজ কাজের ক্ষেত্রের বিষয়েও জানতে চেয়েছে দেশটি। এ সময় নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের মামলার প্রসঙ্গও এসেছে।
যুক্তরাষ্ট্রের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রদূতের বাসায় দুই ঘণ্টার ওই মতবিনিময় অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক আমেনা মহসিন, অধিকার সম্পাদক আদিলুর রহমান খান, নারীপক্ষের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য শিরিন হক ও সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স স্টাডিজের (সিজিএস) নির্বাহী পরিচালক জিল্লুর রহমান।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, বিরোধী দলের সক্ষমতা, নির্বাচন-পরবর্তী পরিস্থিতি, নাগরিক সমাজের কাজের সুযোগ নিয়ে আলোচনা হয়েছে। নাগরিক সমাজের সঙ্গে মতবিনিময়ের পর ঢাকায় যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাস তাদের এক্স (সাবেক টুইটার) হ্যান্ডলে লিখেছে, ‘গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করা এবং ইতিবাচক পরিবর্তনের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে নাগরিক সমাজ। আজ বাংলাদেশের নাগরিক সমাজের সাহসী ও প্রত্যয়ী ব্যক্তিত্বদের সঙ্গে বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করতে পেরে আমরা সন্তুষ্ট। আমরা গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের বিষয়ে তাদের সঙ্গে আলোচনায় যুক্ত থাকব। সরকারকেও তাদের সঙ্গে যুক্ত থাকার আহ্বান জানাব।