টিআইবির প্রতিবেদন হাজার কোটি টাকা চাঁদা ঘুষ ♦ বাস ঘিরে রমরমা বাণিজ্য ♦ রুট পারমিট ও ফিটনেস পেতে ৪৬ শতাংশ মালিককে ঘুষ দিতে হয়

টিআইবির প্রতিবেদন হাজার কোটি টাকা চাঁদা ঘুষ ♦ বাস ঘিরে রমরমা বাণিজ্য ♦ রুট পারমিট ও ফিটনেস পেতে ৪৬ শতাংশ মালিককে ঘুষ দিতে হয়

 

নিজস্ব প্রতিবেদক

 

বাস মালিক এবং শ্রমিকরা বছরে প্রায় ১ হাজার ৬০ কোটি টাকা চাঁদা ও ঘুষ দিতে বাধ্য হচ্ছেন। এর মধ্যে প্রায় ২৫ কোটি টাকা দলীয় পরিচয়ে সড়কে চাঁদাবাজি হয়। এ ছাড়া রাজনৈতিক সমাবেশ, বিভিন্ন দিবস পালন, টার্মিনালের বাইরে (রাস্তায়) পার্কিং এবং সড়কের বিভিন্ন স্থানে ট্রাফিক আইন লঙ্ঘন ও ‘টোকেন বাণিজ্যে’র জন্য ব্যক্তিমালিকানাধীন বাস মালিক ও কর্মী/শ্রমিকরা নিয়মবহির্ভূত চাঁদা ও উৎকোচ দিতে বাধ্য হচ্ছেন। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় অংশ হচ্ছে নিবন্ধন ও সনদ গ্রহণ এবং হালনাগাদ বাবদ ঘুষ। বিআরটিএ’র কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বছরে এজন্য ঘুষ দিতে হয় ৯০০ কোটি টাকার বেশি। গতকাল রাজধানীর ধানমন্ডি মাইডাস সেন্টারে ‘ব্যক্তিমালিকানাধীন বাস পরিবহন ব্যবস্থায় শুদ্ধাচার’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদনে এসব তথ্য তুলে ধরে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। প্রতিবেদনে বলা হয়, মোট পাঁচ খাতে বাস মালিক ও শ্রমিকদের ঘুষ ও চাঁদা দিতে হচ্ছে। এ খাতে সর্বোচ্চ বিআরটিএতে বাসের নিবন্ধন সনদ ও হালনাগাদে বছরে সর্বোচ্চ ৯০০ কোটি ৫৯ লাখ টাকা ঘুষ লেনদেন হয়। এরপর ট্রাফিক ও হাইওয়ে পুলিশকে মামলা এড়াতে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৮৭ কোটি ৫৭ লাখ টাকা ঘুষ দিতে হয়। এরপর দলীয় পরিচয়ে ব্যক্তি বা গোষ্ঠীনামে সড়কে বছরে অবৈধ চাঁদাবাজি হয় ২৪ কোটি ৯৭ লাখ টাকা। সড়কে পার্কিংয়ের জন্য পৌরসভা, সিটি করপোরেশন প্রতিনিধি ও রাজনৈতিক কর্মীর নামে ৩৩ কোটি ৪৮ লাখ, টার্মিনালে প্রবেশ ও বেরোবার জন্য মালিক ও শ্রমিক সংগঠনগুলোর অতিরিক্ত অর্থ আদায়ের পরিমাণ ১২ কোটি ৭৬ লাখ টাকা। এ গবেষণা আরও বলছে, বেসরকারি মালিকানাধীন বাণিজ্যিক পরিবহনের রুট পারমিট, ফিটনেস সনদ ইস্যু ও নবায়নে গড়ে ৪৬ শতাংশের বেশি মালিককে ঘুষ দিতে হয়। মোটরযান সনদ ইস্যু ও নবায়নে বাসপ্রতি ১২ হাজার ২৭২, ফিটনেস সনদ নবায়ন ও ইস্যুতে বাসপ্রতি ৭ হাজার ৬৩৫ এবং রুট পারমিট সনদ নবায়ন ও ইস্যুতে বাসপ্রতি ৫ হাজার ৯৯৯ টাকা ঘুষ দিতে হয়।

এ গবেষণাটি পরিচালনা করেন মুহা. নুরুজ্জামান ফরহাদ, ফারহানা রহমান ও মোহাম্মদ নূরে আলম। অনুষ্ঠানে সার্বিক বিষয় নিয়ে কথা বলেন টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান। গবেষণায় দেখানো হয়, ৩২ জেলার বাস কর্মী/শ্রমিক, মালিক, যাত্রীর ওপর ২০২৩ সালের মে থেকে ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত তথ্য সংগ্রহ, বিশ্লেষণ করা হয়। এ ছাড়া জরিপের কার্যক্রম পরিচালনা করা হয় ২০২৩ সালের ১১ সেপ্টেম্বর থেকে ২২ অক্টোবর পর্যন্ত। চেকলিস্টের মাধ্যমে ৩২ জেলার ৫১ বাস টার্মিনাল পর্যবেক্ষণ করা হয়। এসব জেলার মধ্যে আছে ঢাকার ৬টি, চট্টগ্রামের ৬টি, খুলনার ৫টি, রাজশাহীর ৪টি, রংপুরের ৪টি, বরিশালের ৩টি, সিলেটের ২টি এবং ময়মনসিংহের ২টি।

পরিবহন খাত আপদমস্তক দুর্নীতিতে জর্জরিত মন্তব্য করে ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘ব্যক্তিমালিকানাধীন বাস পরিবহন খাত আপাদমস্তক অনিয়ম-দুর্নীতিতে জর্জরিত। এর পেছনে রয়েছে রাজনীতিসংশ্লিষ্টতায় বলীয়ান মালিক ও শ্রমিকদের আঁতাত। সরকার এখানে তাদের থেকে ক্ষমতাহীন! মালিক-শ্রমিক সংগঠনগুলো ৮০ শতাংশ সরকারি দলের নিয়ন্ত্রণে। রাজনৈতিক দলগুলোর প্রভাবের কারণে পুরো খাতটি জিম্মি হয়ে রয়েছে। এতে কাক্সিক্ষত সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন যাত্রীরা। তারা নানাভাবে হয়রানির শিকার হচ্ছেন।’ গবেষণায় দেখা যায়, ১৮ দশমিক ৯ শতাংশ বাসের নিবন্ধন নেই, ২৪ শতাংশের ফিটনেস নেই, ১৮ দশমিক ৫ শতাংশের ট্যাক্স টোকেন নেই, ২২ শতাংশের রুট পারমিট নেই। ৮২ শতাংশ শ্রমিক চুক্তিভিত্তিক হওয়ায় তাদের কোনো নিয়োগপত্র দেওয়া হয় না। শ্রমিকদের দৈনিক গড়ে ১১ ঘণ্টা কাজ করতে হয়। সর্বোচ্চ ১৮ ঘণ্টা পর্যন্ত তারা কাজ করেন, তাদের কোনো ওভারটাইম ভাতা দেওয়া হয় না। ৪০ দশমিক ৯ শতাংশ বাস কর্মী ও শ্রমিকের মতে সংশ্লিষ্ট কোম্পানির এক বা একাধিক বাসের নিবন্ধনসহ কোনো না কোনো সনদের ঘাটতি আছে। ২২ দশমিক ২ শতাংশ কর্মী বা শ্রমিকের মতে মদপান বা নেশাজাতীয় দ্রব্য সেবন করে চালক গাড়ি চালান এবং কন্ডাক্টর/হেলপার/সুপারভাইজার বাসে দায়িত্ব পালন করেন। ১৭ দশমিক ৯ শতাংশ বাসমালিকের তথ্যে, তার রুটে চলাচলকারী কিছু কোম্পানি যৌথ মূলধন কোম্পানি ও ফার্মগুলোর (আরজেএসসি) পরিদফতরে নিবন্ধিত না। তথ্যদাতারা উল্লেখ করেন, ৬৮ দশমিক ৮ শতাংশ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা ও অন্যান্য সরকারি কর্তৃপক্ষকে নিয়মবহির্ভূত অর্থ দিয়ে, ৫৬ দশমিক ৩ শতাংশ রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তারের মাধ্যমে এবং ৩৭ দশমিক ৫ শতাংশ স্বজনপ্রীতির মাধ্যমে এসব অনিবন্ধিত কোম্পানি ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সড়কে বিভিন্ন দলীয় পরিচয়ের ব্যক্তি বা গোষ্ঠী বাসপ্রতি মাসে গড়ে ২ হাজার ৭৭৯ টাকা চাঁদাবাজি করে। এ রাজনৈতিক ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর মধ্যে বিভিন্ন মালিক সমিতিও রয়েছে। জরিপে অংশগ্রহণকারী নারী বাসযাত্রীর ৩৫ দশমিক ২ শতাংশ যাত্রাপথে কোনো না কোনো সময় যৌন হয়রানির শিকার হন। আর বাসের কর্মী/শ্রমিকের ২৯ শতাংশ বিগত ছয় মাসে বিভিন্ন কারণে ট্রাফিক ও হাইওয়ে পুলিশকে বাসপ্রতি গড়ে মাসে ৩ হাজার ১২৫ টাকা ঘুষ দিয়েছেন বলেও জানান।

জাতীয় শীর্ষ সংবাদ