বেনজীরের বিরুদ্ধে দুদকের অনুসন্ধান, অগ্রগতির প্রতিবেদন চেয়েছেন হাইকোর্ট

বেনজীরের বিরুদ্ধে দুদকের অনুসন্ধান, অগ্রগতির প্রতিবেদন চেয়েছেন হাইকোর্ট

নিজস্ব প্রতিবেদক

 

পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বেনজীর আহমেদের অনিয়ম-দুর্নীতি, ক্ষমতার অপব্যবহার ও অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ অনুসন্ধনে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) যে অনুসন্ধান কমিটি করেছে, সে কমিটির কার্যক্রমের অগ্রগতি প্রতিবেদন চেয়েছেন হাইকোর্ট। আগামী দুই মাসের মাসের মধ্যে কমিটিকে অগ্রগতি প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে।

আজ মঙ্গলবার (২৩ এপ্রিল) এ সংক্রান্ত রিট আবেদনের শুনানির পর বিচারপতি মো. নজরুল ইসলাম তালুকদার ও বিচারপতি কাজী ইবাদত হোসেনের হাইকোর্ট বেঞ্চ এ আদেশ দেন।

বেনজীর আহমেদের পক্ষে শুনানি করেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী শাহ মঞ্জুরুল হক ও মো. সাঈদ আহমেদ রাজা।

দুদকের পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী মো. খুরশীদ আলম খান। আর রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল এ কে এম আমিন উদ্দিন মানিক।
শুনানিতে আদালত বলেছেন, ‘ভারতের মতো বাংলাদেশেও সরকারি চাকরিজীবীদের জন্য ‘সম্পদ বিবরণী আইন’ করা উচিত। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে হলে করতে হলে এরকম আইন করতে হবে।

শুধু বাতাস খেয়ে বেড়ালে হবে না।’
বেনজীর আহমেদের অনিয়ম-দুর্নীতি, ক্ষমতার অপব্যবহার নিয়ে কালের কণ্ঠে প্রকাশিত দুটি প্রতিবেদন উপস্থাপন করে শুনানিতে রিটকারীর আইনজীবী বলেন, এ দুটি প্রতিবেদন প্রকাশের পরও দুদক স্বউদ্যোগে অনুসন্ধানের উদ্যোগ নেয়নি। যে কারণে গত ৪ এপ্রিল দুদক চেয়ারম্যানকে চিঠি দিয়ে অনুসন্ধানের উদ্যোগ নিতে অনুরোধ করা হয়। এতেও কাজ না হওয়ায় গত ১৮ এপ্রিল বিবাদিদের আইনি নোটিশ দেওয়া হয়।

এরপর গতকাল (২২ এপ্রিল) দুদক একটি অনুসন্ধান কমিটি গঠন করেছে। কিন্তু আমরা দেখেছি, দুদক ১০ হাজার অভিযোগ অনুসন্ধান না করে অভিযোগ ওঠা ব্যক্তিদের দায়মুক্তি দিয়েছে। যে কারণে দুদকের অনুসন্ধানে আমরা বিচারিক তদারকী (জুডিশিয়াল সুপারভিশন) চাচ্ছি।
এরপর বেনজীর আহমেদের পক্ষে শুনানি করতে দাঁড়ান আইনজীবী শাহ মঞ্জুরুল হক ও সাঈদ আহমেদ রাজা। শুনানিতে এ দুই আইনজীবী বলেন, ব্যক্তিগত দ্বন্দ্ব থেকে এসব প্রতিবেদন করা হয়েছে।

প্রকাশিত প্রতিবেদনের প্রত্যেকটা পয়েন্ট ধরে ধরে জবাব দেওয়া হয়েছে। তাছাড়া রিটে দুদকের নিষ্ক্রিয়তা চ্যালেঞ্জ করা হয়েছে। কিন্তু দুদক ইতিমধ্যে একটি অনুসন্ধান কমিটি গঠন করেছে। ফলে এখন দুদক নিষ্ক্রিয় এটা বলার সুযোগ নেই। অভিযোগ অনুসন্ধান পর্যায়ে রয়েছে। ফলে বিষয়টিতে আদালতে তদারকি বা হস্তক্ষেপ করলে স্বাধীন অনুসন্ধান হবে না। এতে কমিশন চাপ অনুভব করতে পারে। ফলে অন্তবর্তী আদেশ দেওয়া ঠিক হবে না।
‘অন্যায়-দুর্নীতি করে কেউ যাতে পার পেতে না পারে’

তখন বেঞ্চের জ্যেষ্ঠ বিচারপতি মো. নজরুল ইসলাম তালুকদার বলেন, ‘ভারতের পাবলিক সার্ভিস হোল্ডারদের জন্য সম্পদ বিবরণী আইন আছে। চাকরিতে যোগ দেওয়ার সময় তার কত সম্পদ ছিল আর চাকরি থেকে অবসরে যাওয়ার সময় তার সম্পদের পরিমাণ কত তার বিবরণী একজন সরকারি চাকরিজীবীকে দিতে হয়। যোগ দেওয়ার সময় দেওয়া সম্পদ বিবরণীর সঙ্গে অবসরে যাওয়ার সময় দেওয়া বিবরণীর সঙ্গে সম্পদের পার্থক্য ১০ শতাংশের বেশি হলে ব্যবস্থা নেওয়া হয়। আমাদের দেশে এরকম আইন এখন পর্যন্ত করতে পারিনি। দুদক আইন তো আছেই। সুনির্দিষ্টভাবে এ ধরনের আইন আমাদের দেশেও করা দরকার। করতে না পারলে অর্থ পাচার বলেন, অবৈধ সম্পদ অর্জন বলেন বা দুর্নীতি বলেন কোনোটাই নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন না। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে হলে এ ধরনের আইন করতে হবে। স্বাধীনতার চেতনাকে ধারণ করতে হবে। শুধু বাতাস খেয়ে বেড়ালে হবে না। আমাদের শুধু চোখ খোলা রাখতে হবে। যে কারণে আপনাদের আইনজীবীদের এ ধরনের আইন করতে সরকারকে বলা উচিত। আপনাদের খালি মামলা করলেই চলবে না। রাষ্ট্রের স্বার্থ আপনাদের দেখতে হবে। সরকারি চাকরিজীবী যারা আছেন তারা চাকরিতে যোগ দেওয়ার সময় সম্পদের বিবরণী দিবেন। আবার চাকরি থেকে অবসরে যাওয়ার সময়ও দিবেন। আমরা (আদালত) খালি দেখব যে দুই বিবরণীতে ১০ শতাংশের বেশি পার্থক্য আছে কি না। আমাদের তো তাদের (সরকারি চাকরিজীবীদের) পাহাড়া দেওয়ার দরকার নাই।’

বিচারপতি বলেন, আমরা চাই দুর্নীতি না হোক। আমরা চাই অন্যায়-দুর্নীতি করে কেউ যাতে পার পেতে না পারে।

এরপর দুদকের আইনজীবী খুরশীদ আলম খান অনুসন্ধান কমিটি গঠনের আদেশ উপস্থাপন করে বলেন, সাবেক পুলিশ প্রধানের বিরুদ্ধে এটি গুরুতর অভিযোগ। দুদক ইতিমধ্যে অনুসন্ধান শুরু করেছে।

এরপর আদালত সব পক্ষের যুক্তি উপস্থাপন করে আদেশে বলেন, যেহেতু দুদক ইতিমধ্যে অভিযোগ অনুসন্ধানে কমিটি গঠন করেছে। ফলে এই রিটে রুল জারি কিংবা অন্তবর্তী আদেশে দেওয়ার আর প্রয়োজনীয়তা নেই। যাহোক, অনুসন্ধান কমিটিকে আগামী দুই মাসের মধ্যে অভিযোগের বিষয়ে অগ্রগতি প্রতিবেদন দিতে নির্দেশ দেওয়া হলো।

‘বেনজীরের ঘরে আলাদীনের চেরাগ’ শিরোনামে গত ৩১ মার্চ অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশ করে কালের কণ্ঠ। এর দুই দিনের মাথায় গত ২ এপ্রিল ‘বনের জমিতে বেনজীরের রিসোর্ট’ শিরোনামে দ্বিতীয় দফার অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশ করে।

দুর্নীতি দমন কমিশন আইন, ২০০৪ এর ১৭(গ) ধারা অনুসারে কমিশন কোনো অভিযোগে স্বউদ্যোগে অনুসন্ধান শুরু করতে পারে। কিন্তু বেনজীর আহমেদের অনিয়ম-দুর্নীতি, ক্ষমতার অপব্যবহার নিয়ে পর পর দুটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশের পরও কমিশন অনুসন্ধানের উদ্যোগ নেয়নি। যে কারণে গত ৪ এপ্রিল দুদক চেয়ারম্যানকে চিঠি দিয়ে অনুসন্ধানের উদ্যোগ নিতে অনুরোধ করেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী সালাহ উদ্দিন রিগ্যান। এতেও কাজ না হওয়ায় গত ১৮ এপ্রিল বিবাদিদের আইনি নোটিশ দেন তিনি। নোটিশ প্রাপ্তির তিন দিনের মধ্যে স্বউদ্যোগে অনুসন্ধানের অনুরোধ করা হয়। সাড়া না পেয়ে গত ২১ এপ্রিল হাইকোর্টে রিট করেন তিনি। রিটে বেনজীর আহমেদের অনিয়ম-দুর্নীতি, ক্ষমতার অপব্যবহার অনুসন্ধানে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) নিষ্ক্রিয়তা চ্যালেঞ্জ করা হয়। দুদক চেয়ারম্যান, কমিশনার (তদন্ত), কমিশনার (অনুসন্ধান) ও দুদক সচিবকে বিবাদি করা হয় রিটে। সে রিটটিই আজ মঙ্গলবার শুনানিতে ওঠে।

জাতীয় শীর্ষ সংবাদ