নিজস্ব প্রতিবেদক
মোবাইলের যুগে ধারাবাহিকভাবে কমছে বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশনস কোম্পানি লিমিটেড (বিটিসিএল)-এর টেলিফোন গ্রাহকের সংখ্যা। মাসে ১৫০ টাকায় আনলিমিট প্যাকেজ দিয়েও গ্রাহক ধরে রাখতে পারছে না প্রতিষ্ঠানটি। যাদের ঘরে এখনো সংযোগ আছে, তারাও টেলিফোন তেমন একটা ব্যবহার করেন না। একসময় লাভজনক ব্যবসা ল্যান্ডফোনের দিন ফুরিয়ে আসছে।
বিটিসিএলসূত্রে জানা গেছে, গত এপ্রিলে বিটিসিএলের গ্রাহক ছিল ৪ লাখ ৭ হাজার ৮৯৬ জন। ২০২৩ সালের জুনে গ্রাহক ছিল ৪ লাখ ৫২ হাজার ২৬৮ জন। ২০১৮ সালে এ সংখ্যা ছিল ৬ লাখ ১৬ হাজার। ২০১৪ সালের জুনে গ্রাহক সংখ্যা ছিল ৮ লাখ ৫ হাজার। এ প্রতিষ্ঠানের সংযোগ দেওয়ার সক্ষমতা রয়েছে ১৫ লাখ গ্রাহককে। কিন্তু বর্তমানে প্রায় তিন ভাগের এক ভাগ গ্রাহককে সেবা দিচ্ছে বিটিসিএল। প্রতি বছরই কমছে গ্রাহকসংখ্যা। দেশে একসময় টেলিযোগাযোগের মাধ্যম বলতে ছিল বাংলাদেশ তার ও টেলিফোন বোর্ড (বিটিটিবি)-এর টেলিফোন সেবা, যা টিঅ্যান্ডটি নামে পরিচিত ছিল। এ টেলিফোনের সংযোগ ছিল বহুপ্রতীক্ষিত। এখন নানামুখী ছাড় দিয়েও গ্রাহক ধরে রাখতে পারছে না বিটিসিএল। গ্রাহকসংখ্যা কমতে থাকার মধ্যে বিটিসিএল ২০১৯ সালের আগস্ট থেকে টেলিফোন থেকে টেলিফোনে কথা বলতে মাসে বিল সাকল্যে ১৫০ টাকা নির্ধারণ করে একটি ‘প্যাকেজ’ ঘোষণা করে। টেলিফোন থেকে মোবাইলে কল করলে প্রতি মিনিটে ৫২ পয়সা (ভ্যাট যোগ হবে) দিতে হবে গ্রাহককে। মুজিববর্ষ উপলক্ষে টেলিফোন সংযোগ দেওয়া হয় বিনামূল্যে। বতর্মানে ঢাকার মধ্যে বিটিসিএলের সংযোগ নিতে গ্রাহককে ১ হাজার টাকা সংযোগ ফি এবং ১ হাজার টাকা জামানত ফি দিতে হবে। চট্টগ্রামে ৫০০ টাকা জামানত এবং ৫০০ টাকা সংযোগ ফি নির্ধারণ করা হয়েছে। অন্যান্য জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে সংযোগ নিতে মাত্র ৩০০ টাকা জামানত ও ৩০০ টাকা সংযোগ ফি গুনতে হবে গ্রাহককে। নানামুখী সুবিধা দিয়েও গ্রাহক হারাচ্ছে বিটিসিএল।
বিটিটিবি থেকে বিটিসিএল নামে ২০০৮ সালে যাত্রার সময় উত্তরাধিকারসূত্রে ৮ লাখ ৬৬ হাজার ব্যবহারকারী পেয়েছিল সংস্থাটি। কমতে কমতে ১৬ বছওে পুরো অর্ধেকে নেমে এসেছে গ্রাহকসংখ্যা। মোবাইল ফোন ব্যবহারকারীর সঙ্গে তুলনা করলে সংখ্যাটি তুচ্ছ। দেশে বর্তমানে ১৬৬ মিলিয়নের বেশি মোবাইল ফোন সিম ব্যবহারকারী রয়েছে। ১৮ বছরের বেশি বয়সী জাতীয় আইডি কার্ড আছে, এমন যে-কেউ সর্বাধিক ১৫টি সিম কিনতে পারে। এসব সুবিধার কারণে টেলিফোন থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে গ্রাহকরা। এর সঙ্গে নিত্যদিনের সংযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়া এবং মেরামত ভোগান্তিতে গ্রাহক-আস্থা ঠেকেছে তলানিতে।
গ্রাহক-ভোগান্তি নিরসনে ২৪ ঘণ্টা কল সেন্টার চালু করেছে বিটিসিএল। ১৬৪০২ নম্বরে কল করে বিটিসিএলের সেবাসংক্রান্ত অভিযোগ দিলে স্বল্প সময়ে সমাধান করছে কর্তৃপক্ষ। বিটিসিএলের নেটওয়ার্ক মনিটরিং এবং সামগ্রিক সেবা ব্যবস্থাপনায় বিশ্বমানের এনওসি স্থাপন করা হয়েছে। গ্রাহকসেবা নিশ্চিত করতে ‘টেনিজস্ব প্রতিবেদকলিসেবা’ নামে অ্যাপ উদ্বোধন করা হয়েছে। অ্যান্ড্রয়েড, আইওএস ও ওয়েব প্ল্যাটফরমের ‘টেলিসেবা’ অ্যাপের মাধ্যমে গ্রাহকের অভিযোগ গ্রহণ ও ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে।
রাজধানীর ধানমন্ডির বাসিন্দা ব্যবসায়ী রজত চৌধুরী বলেন, ‘আমাদের বাসায় ছোটবেলা থেকেই টেলিফোন দেখছি। আগে ঝড়বৃষ্টি, রাস্তা খোঁড়াখুঁড়িতে প্রায়ই সংযোগ বিচ্ছিন্ন হতো। সে সংযোগ চালু করতে রীতিমতো অশান্তিতে পড়তে হতো। এখন সবার হাতে হাতে মোবাইল থাকায় আমার মা ছাড়া টেলিফোন তেমন কেউ ব্যবহার করে না। কিছুদিন আগে সংযোগ বিচ্ছিন্ন হলে বিটিসিএলের কল সেন্টারে অভিযোগ দিলে দেখলাম পর দিন এসে ঠিক করে দিয়ে গেছে।’ সেবায় বৈচিত্র্য আনতে ‘আলাপ’ নামে বিটিসিএল আইপি কলিং অ্যাপ চালু করেছে। এ অ্যাপের মাধ্যমে ফ্রি অননেট কল, এইচডি ভিডিও কল, সাশ্রয়ী অফনেট কল, ভিডিও কনফারেন্সসহ আকর্ষণীয় ফিচারসহ অ্যাপটি বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছে। কিন্তু এসব উদ্যোগ গ্রাহক বাড়াতে পারছে না, বরং কমেছে। ২০০৭-০৮ অর্থবছরে বিটিসিএলের লোকসান ছিল প্রায় ৩৫০ কোটি টাকা। তার আগে ছিল প্রায় ৫০০ কোটি টাকা। ২০২০-২১ অর্থবছরেও বিটিসিএলের লোকসান ছিল ২৪৭ কোটি টাকা। দীর্ঘ ১২ বছরের একটানা লোকসান কাটিয়ে ২০২১-২২ অর্থবছরে ৬ কোটি ৭২ লাখ টাকা লাভ করেছে প্রতিষ্ঠানটি। ২০২২-২৩ অর্থবছরে লাভ হয়েছে মাত্র ১৪ লাখ ৪৯ হাজার টাকা। এ ব্যাপারে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিটিসিএলের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, টেলিফোন সেবার মান বাড়াতে বিটিসিএল নানা উদ্যোগ নিয়েছে। সংযোগের জন্য আবেদন থেকে শুরু করে বিল দেওয়া পর্যন্ত পুরো কাজই এখন ডিজিটাল ব্যবস্থায় হচ্ছে। টেলিফোনে সংযোগ কিংবা যে কোনো সমস্যা দ্রুত সমাধান করা হচ্ছে। তবে প্রযুক্তির পরিবর্তন হওয়ায় গ্রাহকের টেলিফোনে আগ্রহ কম। আমরা অন্যান্য সেবার মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানটি ধরে রেখেছি। টেলিফোন আমাদের ঐতিহ্য। এটা ধরে রাখতে আমরা কাজ করছি।