বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর বলেছেন, আমাদের প্রথম দায়িত্ব দেশের অর্থনীতিতে স্থিতিশীলতা নিয়ে আসা। মূল্যস্ফীতি ৫-৬-৭ শতাংশে নিয়ে আসা। ডলারের বিনিময় হার ১২০ টাকার আশপাশে স্থির রাখা। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ আরেকটু স্থিতিশীল করে আস্তে আস্তে বাড়ানো। অপরিশোধিত বিলগুলো পরিশোধ করে শূন্যের কোঠায় নিয়ে যাওয়া। বিশ্ববাজারের কেউ যাতে বলতে না পারে বাংলাদেশ পেমেন্ট দিতে পারে না। আমি মনে করি, এক বছরের মধ্যে বাংলাদেশের অর্থনীতির চেহারা পাল্টে ফেলতে পারব। তিনি বলেন, কিছু ব্যাংক নাজুক অবস্থায় আছে। তবু যার যেখানে আমানত আছে সেখানেই রাখুন। আপনার পুরো টাকা সুদাসলসহ ফেরত পাবেন। বাংলাদেশ প্রতিদিনকে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে তিনি এসব কথা বলেছেন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান দায়িত্ব মূল্যস্ফীতি কমিয়ে আনা। আগে নীতিগত ভুলভ্রান্তির কারণে মূল্যস্ফীতি কমার বদলে বেড়ে গিয়েছিল। এখানে আমাদের কাজ করতে হচ্ছে। দুই বছর ধরে ব্যালান্স অব পেমেন্টে একটা বড় ধরনের অস্থিতিশীলতা আছে। এটা সামাল দিতে হবে। আশা করছি, এক বছরের মধ্যে অর্থনীতির চেহারা পাল্টে ফেলতে পারব।
আগামী মাসগুলোয় মূল্যস্ফীতি আরও একটু কমে আসবে বলে আমি আশাবাদী। অফিশিয়ালি আমাদের টার্গেট হচ্ছে চলতি অর্থবছরের শেষ নাগাদ মূল্যস্ফীতি ৭ শতাংশে নামিয়ে আনা। আশা করছি, এপ্রিল-মের মধ্যেই লক্ষ্য পূরণ হবে। তার পরে আমরা ৬ অথবা ৫ শতাংশে নামিয়ে আনার চেষ্টা করব। আমরা যদি মূল্যস্ফীতি ৫ শতাংশে নামিয়ে আনতে পারি, তাহলে অবশ্যই সুদহার কমিয়ে আনতে পারব। সুদহার কমে এলে বাজারে একটা চাহিদা তৈরি করে ঋণের প্রবাহ বাড়াতে পারব। প্রবৃদ্ধির দিকে আমরা নজর দিতে পারব। আমরা নীতি সুদহার বাড়িয়েছি। বিদ্যমান নীতি সুদহার ৮ দশমিক ৫০ শতাংশ থেকে ৫০ ভিত্তি পয়েন্ট বাড়িয়ে নতুন সুদহার নির্ধারণ করা হয়েছে। এ মাসে সেটা ৯ দশমিক ৫০ শতাংশে নিয়ে যাব, পরবর্তী মাসে ১০ শতাংশে নিয়ে যাব। এটা আমাদের পূর্বপরিকল্পনা। আগামীতে কাজ হবে কি হবে না সেটা দেখব। দেখার পরে ভবিষ্যতে বাড়ানোর দরকার হলে বাড়াব। না হলে আমরা ওখানেই থেমে যাব।
সাধারণ মানুষের জন্য সবচেয়ে বড় এবং কঠিন সমস্যা মূল্যস্ফীতি। মূল্যস্ফীতি বড়লোককে আরও বড়লোক করে, গরিবকে গরিব করে। যাদের সম্পদ আছে তাদের সম্পদের পরিমাণ বেড়ে যায়। যারা আয়ের ওপর নির্ভরশীল তাদের আয়টা কমে যায়। ক্রয়ক্ষমতা কমে যায়। আমাদের লক্ষ্য চলতি অর্থবছর শেষে মূল্যস্ফীতি ৬-৭ শতাংশে নিয়ে আসা এবং পরে ৪-৫ শতাংশে নিয়ে আসা। দেশের ইতিহাসে ৪-৫ শতাংশ মূল্যস্ফীতি হয়নি। যদি আমরা করতে পারি, তাহলে সরকারের জন্য একটি বড় অর্জন হবে বলে মনে করি। সে লক্ষ্যে আমরা কাজ করছি, করতে পারলে সাধারণ মানুষের উপকার হবে। কীভাবে প্রকৃত মজুরি বাড়াতে পারি সেদিকেই নজর দিতে হবে।
ডলারের বিপরীতে টাকার বিনিময় হার এখন ১২০ টাকায় স্থিতিশীল থাকায় আমি আশাবাদী। তিন মাস ধরেই এটা স্থিতিশীল আছে। খোলাবাজারের সঙ্গে এখন আর পার্থক্য নেই। প্রবাসী আয়ে প্রণোদনা দেওয়ার পর ব্যাংকের ডলারের দাম খোলাবাজারে কম। বাংলাদেশের ইতিহাসে এটা কখনো হয়নি। এখন বৈধ চ্যানেলে রেমিট্যান্স পাঠালে অবৈধ চ্যানেলের চেয়ে বেশি টাকা পাবেন। এ জিনিস প্রথম আমরা দেখতে পাচ্ছি। এটা হচ্ছে ইতিবাচক দিক। ১৪ আগস্ট আমি গভর্নরের দায়িত্ব নেওয়ার সময় সরকারের সার, গ্যাস, তেল আমদানির অপরিশোধিত বিলের পরিমাণ ছিল ২ বিলিয়ন ডলার। এক মাসের ব্যবধানে বকেয়ার পরিমাণ নেমে এসেছে ১ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলারে। ৮০০ মিলিয়ন আমরা কমিয়ে ফেলেছি। ইনশাল্লাহ আমরা দুই-তিন মাসের মধ্যে এটা শূন্যের কোঠায় নিয়ে যেতে পারব। তো আমরা আশাবাদী, যে জিনিসগুলো হয়েছিল সেখান থেকে আমরা বেরিয়ে আসতে পারব। আমরা কখনোই পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কার মতো হইনি। তবে চাই রিজার্ভ আরও বাড়ুক। এখন পর্যন্ত তিন মাসের আমদানি ব্যয় মেটানোর মতো রিজার্ভ আমাদের আছে। এটা অবশ্যই সেভাবে রাখতে হবে অথবা বাড়াতে হবে। অতীতে ১ থেকে ১ দশমিক ১ বিলিয়ন ডলার রিজার্ভ থেকে বাজারে ছাড়া হতো। গত এক মাসে আমি ১ ডলারও বাজারে ছাড়িনি। উল্টো কিছু কিনেছি। আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার বাজারটা কিন্তু বড়। আমদানি ব্যয় মেটাতে প্রয়োজন হয় ৭৫-৮০ বিলিয়ন ডলার। সেবা খাতে পরিশোধ হয় আরও ৫ বিলিয়নের মতো। সব মিলিয়ে আমাদের ৯০ বিলিয়নের মতো খরচ হয়। সেখানে আমাদের রপ্তানি আয় থেকে আসে ৫০ বিলিয়ন ডলারের মতো। রেমিট্যান্স আছে প্রায় ২৪ বিলিয়ন। সেবা খাতে আসে আরও ৫-৬ বিলিয়নের মতো। আমি চাই এ ৮০ বিলিয়ন থেকেই যেন সবাই তাদের ব্যয় মেটাতে পারেন। রিজার্ভ থেকে যেন আর এক পয়সাও সহায়তা দিতে না হয়। বিনিময় হারটা পুরোপুরি বাজারে ডলারের চাহিদা এবং সরবরাহের ওপর নির্ভর করে নির্ধারণ হবে। ১ ডলার বিক্রি না করেও বিনিময় হার ১২০ টাকাতেই আছে। প্রতিবেশী দেশগুলোর তুলনায় আমাদের দেশে সুদহার অনেক বেশি। ফলে টাকা এখন অনেক বেশি আকর্ষণীয়। টাকায় ১২ থেকে ১৪ শতাংশ পর্যন্ত সুদ নেওয়া হচ্ছে। ডলারে সুদ হচ্ছে ৫-৬ শতাংশ। ৫-৬ শতাংশ থেকে ১৪ শতাংশের মধ্যে বিশাল পার্থক্য। আমি কেন ডলার কিনতে যাব, আমার টাকা আমি টাকাতেই রাখব। সেজন্য এ পার্থক্যটা আমাদের ধরে রাখতে হবে। আস্তে আস্তে আমরা এ পার্থক্য কমিয়ে আনব। যুক্তরাষ্ট্রের মূল্যস্ফীতি ২ দশমিক ৫ শতাংশ। বাংলাদেশে ১১ দশমিক ৫ শতাংশ। মুদ্রামান তো এক থাকতে পারে না। কাজেই মূল্যস্ফীতি যদি ৪ শতাংশে নামিয়ে আনতে পারি। তাহলে পার্থক্য হবে ১ থেকে ২ শতাংশ। এ স্থিতিশীলতা আনাই হচ্ছে মূল লক্ষ্য।
সরকার ব্যাংক থেকে ১ লাখ ৩৭ হাজার কোটি টাকা ধার করার লক্ষ্য নিয়েছে। আমরা বলেছি, সরকার এ অর্থ কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে নিলে ব্যক্তি খাতে কোনো ঋণ থাকবে না। বছরে আমাদের মোট আমানত ১ লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকা। কাজেই আমরা বলেছি সরকারি ঋণের চাহিদা ৮০ হাজার কোটি টাকায় নামিয়ে আনতে। সেটা হলে ৫৫ হাজার কোটি টাকা আমরা ব্যক্তি খাতে দিতে পারব। তাহলে ব্যক্তি খাত সরকারের চেয়ে একটু বেশি ঋণ পাবে। সরকার ব্যয় সংকোচনেরও চেষ্টা করছে। কেটে ফেলছে অপ্রয়োজনীয় ব্যয়। আমি আশাবাদী, এ অর্থবছরের শেষ নাগাদ মুল্যস্ফীতি ৫-৬ শতাংশে চলে আসবে।
ব্যাংক খাতের সমস্যা বিশাল। আমরা জানি, একটি বড় শিল্প গোষ্ঠী ২০১৭ সাল থেকে সাত বছরে সবকটি ইসলামী ব্যাংকই কবজা করেছিল। নিয়ন্ত্রণে নিয়ে ব্যাপক সম্পদ বের করে বিদেশে পাচার করেছে। তাদের সম্পদের একটা অংশ এখনো দেশে আছে। আমাদের ধারণা, একটা পরিবার হয়তো ১ লাখ ১৫ থেকে ২০ হাজার কোটি টাকা নিয়ে গেছে। সঙ্গে আরও দুই-তিনটা গোষ্ঠী মিলে ২ লাখ কোটি টাকার মতো বের করে বিদেশে পাচার করেছে। আলজাজিরার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সাবেক ভূমিমন্ত্রী লন্ডনে ৩৬০টি বাড়ি কিনেছেন। তাঁর ভাইও নাকি সমপরিমাণ বাড়ি কিনেছেন। দুবাই, নিউইয়র্কের ম্যানহাটন, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়ায়ও বাড়ি আছে। সম্পদের শেষ নেই! এ সম্পদগুলো আমরা কীভাবে ফিরিয়ে আনতে পারি সেটা চেষ্টা করব। এ ব্যাংকগুলোর অবস্থা খুবই নাজুক। আমরা এ ব্যাংকগুলোয় নতুন পর্ষদ দিয়েছি। তারা নতুনভাবে সাজাবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক বিশালভাবে সহায়তা করছে। আমরা তাদের সব ধরনের সহায়তা দিচ্ছি। প্রতিটি ঋণ রিভ্যালুয়েট করব। এসব ঋণের মালিক আছে নাকি নেই। যে মালিকের নাম দেওয়া হয়েছিল, সে কি বাস্তবে আছে নাকি ঠিকানা নেই। সেগুলো বের করতে হবে। যারা ঢাকায় আছেন, তাদের কাছ থেকে আমরা আদায় করতে পারব। সেটা আলোচনার মাধ্যমেই হোক আর আদালতের মাধ্যমেই। আর কিছু অর্থ বিভিন্ন গোষ্ঠী জালিয়াতির মাধ্যমে নিয়ে গেছে, সেগুলো তো আমরা সহজে আনতে পারব না। সে ক্ষেত্রে আমাদের সম্পদ উদ্ধার কার্যক্রম চালাতে হবে। ব্যাংক খাত নিয়ে আমরা তিনটি টাস্কফোর্স করছি। একটি ব্যাংক খাত সবল করে তোলার জন্য। সরকার কোনো ব্যাংকের মালিকানা চায় না। ইসলামী ব্যাংকের ৯০ শতাংশের বেশি মালিকানা একটি গোষ্ঠীর হাতে। তারা এখানে নেই। কাজেই সেটা রক্ষণাবেক্ষণের দায়ভার সরকারকে নিতেই হবে। তাদের না পাওয়া গেলে, ঋণ তারা শোধ করতে না পারলে তাদের শেয়ারগুলো অন্য মালিকদের হস্তান্তর করব। তারা টাকা দেবে সেটা আমানতকারীদের দিয়ে দেব। তাদের অন্য যেসব সম্পদ আছে, সেগুলো আমরা অ্যাটাচ করার চেষ্টা করব। আমানতের যে বড় ধরনের ক্ষতি করেছে সেটা আমরা পূরণ করব। আমাদের উন্নয়ন সহযোগীদের বলেছি, তারা যেন আমাদের আর্থিক সহায়তা দেয়। আর্থিক সহায়তা এবং সরকারের কাছ থেকে টাকা নিয়ে ব্যাংকগুলোকে রিক্যাপিটালাইজড্ করব। তাতে ব্যাংকগুলো শক্তিশালী হবে, এটাই আমাদের লক্ষ্য। ছোট ছোট ব্যাংকগুলো একীভূত করে শক্তিশালী বড় ব্যাংক করা হবে।
আমার ব্যক্তিগত মত হচ্ছে, একই পরিবারের দুজনের বেশি পরিচালক দুই মেয়াদের বেশি থাকা উচিত না। আইনে পরিবর্তন আনতে হবে। বিগত সরকার ব্যাংক মালিকদের চাপে আইন পরিবর্তন করেছিল। আমরা আবার আইন সংশোধন করব। এটা হবে আন্তর্জাতিক মানের। বিশ্বব্যাপী যে চর্চা আছে, আমরা সেটাই বাস্তবায়ন করব। আমরা নতুন কিছু করব না। বাংলাদেশেও আন্তর্জাতিক মানের আইন করে আন্তর্জাতিক মানের গ্রহণযোগ্য ব্যাংকব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করব।
বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে বলব, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তাদের অযৌক্তিক অনুরোধ গ্রহণ করবেন না। বাংলাদেশ ব্যাংকের কোনো কর্মকর্তা যদি অনৈতিক সুবিধা দাবি করেন আমাদের নজরে আনুন, আমরা প্রশাসনিক ব্যবস্থা নেব। আমরা কোনো অপসংস্কৃতি, দুর্নীতি প্রশ্রয় দেব না। কিন্তু আমাকে সহযোগিতা করতে হবে। আপনারা আমাকে বলবেন না কিন্তু সংবাদমাধ্যমে বলবেন সেটা হবে না। আগে আমাকে বলতে হবে। অনেক জায়গায় আমরা অযথা হস্তক্ষেপ করি। যেমন একজন এমডি বিদেশে যাবেন কি যাবেন না সেটা দেখার দায়িত্ব আমার না। তাদের পর্ষদ আছে, চেয়ারম্যান আছেন তাঁরা দেখবেন। কাকে চাকরি দেবেন, বেতন কত দেবেন, কতদিন রাখবেন-কোনো কেন্দ্রীয় ব্যাংক এগুলো দেখে না। এগুলো যার যার পর্ষদ এবং ব্যবস্থাপনার। অপ্রয়োজনীয় হস্তক্ষেপ আমরা করব না। অপ্রয়োজনীয় হস্তক্ষেপ যখন করতে যাই, তখন অপ্রয়োজনীয় একটা ক্ষমতা চলে আসে। অপ্রয়োজনীয় হস্তক্ষেপ না থাকলে ব্যাংকগুলোও তখন অযৌক্তিক সুবিধা দেবে না।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বায়ত্তশাসনটা গুরুত্বপূর্ণ। এটা একটা ফায়ারওয়াল তৈরি করে; সরকার যাতে অযৌক্তিক কোনো দাবি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে করতে না পারে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের যেন সেটা প্রতিরোধ করার সক্ষমতা থাকে। এটা কীভাবে হবে। যেমন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট যদি বলেন সুদহার কমাও তারা কমাবে না। তাদের যখন মনে হবে এখন আমাদের কমাতে হবে তখন তারা কমাবে। প্রেসিডেন্ট যদি সুদহার বাড়াতে নিষেধ করেন, মূল্যস্ফীতি বেড়ে গেলেও তারা বাড়াবে। এটা সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধান জানেন ফলে তারা এ অনুরোধই করবেন না। অনুরোধ করলে রাজনৈতিক ঝড় বয়ে যাবে। এ ফায়ারওয়ালটা আমাদের তৈরি করতে হবে। স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান হিসেবে কেন্দ্রীয় ব্যাংককেই করতে হবে। এজন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতিনির্ধারক গভর্নর, ডেপুটি গভর্নরের পদগুলো খুবই শ্রদ্ধাশীল পদ হিসেবে চিহ্নিত করতে হবে। যারা নীতিমান, আন্তর্জাতিক বা দেশে খ্যাতিসম্পন্ন, মানসম্পন্ন তাঁদের এসব জায়গায় বসাতে হবে। তাঁরা রাজনৈতিক চাপগুলো উপেক্ষা করতে পারবেন। আমি করব না, আমার চাকরি যায় যাক। এটুকু বলার সাহস থাকতে হবে। স্বায়ত্তশাসন হচ্ছে প্রথম এবং গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। আমি চেষ্টা করব এ সরকার যেন কেন্দ্রীয় ব্যাংককে স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। এটা কেন্দ্রীয় ব্যাংক সংস্কারের বড় একটা অংশ হিসেবে থাকবে। একই সঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গুরুত্বপূর্ণ পদের ব্যক্তি নির্বাচন যেন একটা প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে হয়, সেটাও নিশ্চিত করতে হবে। কোনো বিশেষ ব্যক্তির পছন্দের ব্যক্তির নামে যেন চিঠি ইস্যু করা না হয়। এটা করতে পারলে বহুলাংশে মর্যাদা বৃদ্ধি পাবে। একটা পদের মর্যাদা বৃদ্ধি হলে ভালো লোকও আসবে। আমি আশা করি আগামীর কেন্দ্রীয় ব্যাংক সেভাবেই গড়তে পারব। কেন্দ্রীয় ব্যাংক হবে একটি ফোকাল সংস্থা। ব্যাংক খাতের অবস্থা দ্রুততার সঙ্গে পর্যবেক্ষণ করা এবং কোথাও কোনো অবক্ষয় হলে দ্রুত সেটা দূর করার ব্যবস্থা করা এবং শাস্তির ব্যবস্থা করা হচ্ছে আমাদের দায়িত্ব। এগুলোয় আমরা ফিরে যাব। কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে বাণিজ্যিক ব্যাংকের কাছে কোনো অনুরোধ যাবে না। নিয়ন্ত্রক সংস্থা সুবিধা চাইলে নিয়মনীতির সঙ্গে সমঝোতা হয়ে যায়।
দেশে দুটি শক্তিশালী ইসলামী ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করা হবে। এর মধ্যে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড নামে একটি ব্যাংক আছে। সেটায় ইন্টারন্যাশনাল ফাইন্যান্স করপোরেশনকে বিনিয়োগের অনুরোধ করেছি। তারা ৫ থেকে ১০ শতাংশ শেয়ারের মালিকানা নিলে অন্যরা নেবে ৫০ শতাংশ শেয়ার। এতে ব্যাংকটির কমপ্লায়েন্স পরিপূর্ণভাবে বাস্তবায়ন হবে। আবারও ঘুরে দাঁড়াবে। এ ছাড়া ছোট ছোট ইসলামী ব্যাংকগুলো একীভূত করে আরও একটি বড় শক্তিশালী শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংক তৈরি করা হবে। সেটাও করা হবে দেশের ভালো মালিকানা দিয়ে। এতে দুটি শক্তিশালী ইসলামী ব্যাংক প্রতিযোগিতার মাধ্যমে ব্যবসা করতে পারবে। সেটা করার চেষ্টা করছি। যার যেখানে টাকা আছে সেখানেই রাখুন। এক ব্যাংক থেকে আরেক ব্যাংকে সরাবেন না। আস্থা রাখুন সবার টাকাই ফেরত পাবেন। একটু সময় দিন।
নগদকে আমরা মারতে চাইলে এতদিনে নগদ মরে যেত। সেটা আমাদের লক্ষ্য না। আমাদের উদ্দেশ্য, নগদকে বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিস প্রোভাইডার কোম্পানি হিসেবে গড়ে তোলা। ‘বিকাশ’-এর মতো স্বচ্ছ একটি প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তোলা। বিকাশের সুশাসন ও কমপ্লায়েন্স নিয়ে কেউ প্রশ্ন তুলবে না। বিগত সরকারের যথেষ্ট চেষ্টা ছিল বিকাশকে দাবিয়ে রাখার কিন্তু পারেনি স্বচ্ছতার কারণে। আমরা চাই ইন্টারন্যাশনাল ফাইন্যান্স করপোরেশন, আন্তর্জাতিক প্রযুক্তি কোম্পানি যেন নগদে বিনিয়োগ করে। নগদের কৌশলগত অংশীদার হয়। তারা যেন নগদকে একটা উচ্চপর্যায়ে নিয়ে যায়। যত বেশি প্রতিযোগী থাকবে, জনগণ তত বেশি ভালো সেবা পাবেন। সার্ভিস চার্জ কমে আসবে, সেবার মান বেড়ে যাবে। আমি নিশ্চিত, নগদকে অধিগ্রহণ করার পর কোনো গ্রাহক নগদ ছেড়ে যাননি। সবাই আগে যেভাবে ছিলেন এখনো সেভাবেই আছেন। নগদের দৈনিক লেনদেন আগের মতো এখনো ৯০০ কোটি টাকাই আছে। ইতিবাচক দিক কোনো ক্ষতি হয়নি। আমরা চেষ্টা করব লেনদেন ৯০০ কোটি টাকা থেকে কয়েক হাজার কোটিতে নিয়ে যেতে। বিনিয়োগকারী এনে তাদের হাতে দেওয়া হবে। সরকার এখানে বেশিদিন থাকতে চায় না। সরকারের শেয়ার থাকবে নামমাত্র। অপপ্রচার করা হচ্ছে যে, আমরা বিকাশের হয়ে কাজ করছি, নগদকে ধ্বংস করছি, এগুলো মিথ্যা। সেটাই যদি হতো নগদকে আমরা গতকালই মেরে দিতে পারতাম। আমরা চাই নগদ এবং বিকাশ সমানভাবে প্রতিযোগিতা করে জনগণকে সেবা দিক।
এক ব্যাংকের পরিচালক আরেক ব্যাংক থেকে টাকা নিয়ে পরিশোধ করবেন না এটা আমরা হতে দেব না। তাঁরা আঁতাত করে, ষড়যন্ত্র করে পরস্পরকে ঋণ দিয়ে ব্যাংকের ক্ষতি করেছেন। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দায়িত্ব হচ্ছে এ ক্ষতিটা রক্ষা করা। এখানে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আগের কর্ণধারদের ব্যর্থতা ছিল। হয়তো তাঁরা জানতেন কিন্তু কিছু করেননি। রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ ছিল, প্রভাব ছিল। এ ধরনের অপকর্ম যাতে না হয়, সেজন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংককে শক্তিশালী করতে হবে। স্বায়ত্তশাসন জোরদার করতে হবে।
ব্যাংক খাতের জন্য একটি নিয়ন্ত্রক সংস্থা থাকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। একাধিক নিয়ন্ত্রক হলে বিভিন্ন ধরনের সমস্যা দেখা দেয়। ব্যাংক খাতের সংস্কারের অংশ হিসেবে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ থেকে ব্যাংক খাতকে অবমুক্ত করে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে শক্তিশালী করা হবে।