রাজধানীর রায়েরবাগের বাসিন্দা সৌরভ আহমেদ। তিনি ঢাকার চকবাজারে শিশুদের খেলনার ব্যবসা করেন। স্ত্রী, দুই ছেলে আর মাকে নিয়ে তার সংসার। সৌরভের মা সালেহা বেগম দীর্ঘদিন ধরে কিডনি রোগে ভুগছেন। তাকে প্রতি সপ্তাহে দুবার ডায়ালাইসিস করাতে হয়। প্রতিবার ডায়ালাইসিসে ব্যয় হয় ৩ হাজার টাকার বেশি। ফলে প্রতি মাসে শুধু ডায়ালাইসিসেই খরচ হয় ২৪ হাজার টাকার বেশি। এরপর ওষুধ, চিকিৎসক বিল, বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও যাতায়াতে ওই পরিবারের ব্যয়ের বোঝা ৪০ থেকে ৫০ হাজার টাকা। এই টাকার জোগান দিতে পরিবারটিকে হিমশিম খেতে হয়।
শুধু সৌরভের মা নন, দেশে ৮ লাখের বেশি মানুষের ডায়ালাইসিস প্রয়োজন। অথচ সরকারি ও বেসরকারি আড়াইশ সেন্টারে মাত্র ৩০ হাজার রোগীর এই সেবা গ্রহণের সুবিধা রয়েছে। এসব সেবাও শুধু শহরকেন্দ্রিক। এতে একদিকে যেমন মধ্যবিত্ত ও নিম্ন আয়ের মানুষের দীর্ঘদিন চিকিৎসা চালিয়ে যাওয়া অনেকটা অসম্ভব, তেমনি অনেকে কিডনি ডায়ালাইসিস সেবা চালিয়ে যাওয়ার জন্য ভিটামাটি বেঁচে নিঃস্ব হচ্ছেন। মাসে মাসে বিপুল ব্যয়ের চাপ থেকে বাঁচতে অনেকে কিডনি প্রতিস্থাপনের চেষ্টা চালান। সেখানেও রয়েছে প্রতারিত হওয়ার আশঙ্কা।
সম্প্রতি বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) এক গবেষণায়ও কিডনি ডায়ালাইসিস প্রয়োজন—এমন রোগীদের সংকটের কথা উঠে এসেছে। এতে দেখা যায়, দেশের যেসব কিডনি রোগীকে নিয়মিত ডায়ালাইসিস সেবা নিতে হয়, তাদের মাসে গড়ে ৪৬ হাজার ৪২৬ টাকা ব্যয় হয়। বড় অঙ্কের এই ব্যয় করতে গিয়ে আর্থিক সংকটে পড়েন ৯৩ শতাংশ রোগী। পরে এসব রোগীর পরিণতি হয় অকালমৃত্যু। গবেষণাটিতে ২০২৩ সালের ১ নভেম্বর থেকে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত দুই মাস সরকারি ও বেসরকারি সংস্থাভিত্তিক (এনজিও) হাসপাতালের ৪৭৭ রোগীর ওপর জরিপ করা হয়েছে।
তথ্যমতে, সারা দেশে সরকারি ৪৫টিসহ এখন প্রায় আড়াইশটি সেন্টারে কিডনি ডায়ালাইসিস সেবা চালু রয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানে ৩০ হাজারের মতো মানুষের সেবার সক্ষমতা রয়েছে। অথচ প্রায় ৮ লাখ মানুষের নিয়মিত ডায়ালাইসিস প্রয়োজন। অন্যদিকে প্রতি মাসে ৫ হাজার মানুষের কিডনি প্রতিস্থাপনের চাহিদা থাকলেও সম্পন্ন হচ্ছে মাত্র ৩০০-এর কাছাকাছি। আইনি জটিলতায় অনেকটা বাধ্য হয়ে বহুগুণ খরচে দেশের বাইরে গিয়ে প্রতিস্থাপন করছেন অনেকেই। যারা বিদেশ যেতে পারছেন না বা দেশেও প্রতিস্থাপনের খরচ জোগাতে পারছেন না, তারা ধুঁকে ধুঁকে মৃত্যুর দিকে ধাবিত হচ্ছেন।
আউট অব পকেট কস্ট অব কিডনি ডায়ালাইসিস ইন বাংলাদেশ শীর্ষক বিআইডিএসের গবেষণায় দেখা গেছে, ডায়ালাইসিসের পেছনে দেশের একজন কিডনি রোগীকে মাসে সর্বনিম্ন ৬ হাজার ৬৯০ টাকা এবং সর্বোচ্চ ২ লাখ ১০ হাজার টাকা খরচ করতে হয়। গড় ব্যয় ৪৬ হাজার ৪২৬ টাকা। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি, ৩৫ দশমিক ২৮ শতাংশ ব্যয় হয় ডায়ালাইসিসে। এ ছাড়া কনসালটেশন ফি ২ দশমিক ৪১, ওষুধ কিনতে ২২ দশমিক ৮৭ এবং পরীক্ষা-নিরীক্ষায় ১০ দশমিক শূন্য ১ শতাংশ ব্যয় হয়। আরও আছে শয্যা ভাড়া ২ দশমিক ৪৯, চিকিৎসা সরঞ্জাম ব্যয় ৪ দশমিক শূন্য ৪ এবং অন্যান্য খাতে খরচ হয় ১ দশমিক ৭০ শতাংশ। নন-মেডিকেল ব্যয়ের মধ্যে রয়েছে যাতায়াতে ৮ দশমিক ৫৩, খাদ্যে ২ দশমিক ৭৪ এবং সেবা পেতে ঘুষ দিতে হয় শূন্য দশমিক ১২ শতাংশ।
সেবা নিতে রোগীরা কোথায় যান, তারও একটা চিত্র উঠে এসেছে গবেষণায়। সেখানে দেখা যায়, ডায়ালাইসিস সেবা নিতে রোগীদের ৪২ দশমিক ৫৬ শতাংশ যান এনজিওভিত্তিক হাসপাতালে। সরকারি হাসপাতালে যান প্রায় ৩৩ দশমিক ৫৪ শতাংশ। বেসরকারি হাসপাতালে যান ২৩ দশমিক ৯ শতাংশ রোগী। ব্যয় বেশি বেসরকারি হাসপাতালে, মাসে গড়ে খরচ ৭৭ হাজার ৫৮৯ টাকা। সরকারিতে এই ব্যয় ৩২ হাজার ৫৫২ টাকা এবং এনজিওভিত্তিক হাসপাতালে ৩৯ হাজার ৯১২ টাকা।
গবেষণায় দেখা গেছে, প্রায় ৯২ দশমিক ৮৭ শতাংশ পরিবারই ডায়ালাইসিস করাতে গিয়ে আর্থিক সংকটে পড়ে। সাড়ে ১৯ শতাংশ রোগী প্রয়োজনের চেয়ে কম ডায়ালাইসিস করান। ডায়ালাইসিস কম করানোর কারণ হিসেবে আর্থিক অসংগতির কথা উল্লেখ করেছেন ৯৫ শতাংশের বেশি। মানুষের পকেট থেকে যে টাকা বেরিয়ে যাচ্ছে, এর মধ্যে শুধু ডায়ালাইসিস ফি দিতেই মাসে বয় ৪৫৮ টাকা থেকে ৭৮ হাজার টাকা। এ ছাড়া ডায়ালাইসিসে যুক্ত আরও প্রায় ছয় ধরনের সরাসরি মেডিকেল চিকিৎসাসংক্রান্ত ব্যয় ৪ হাজার ২৮০ টাকা এবং সর্বোচ্চ ২ লাখ ২ হাজার ৮০০ টাকা। অন্যদিকে কিডনি রোগীর ডায়ালাইসিস করাতে ছয় ধরনের নন-মেডিকেল খরচ হয় শূন্য থেকে ৯২ হাজার ৬০০ টাকা।
বিআইডিএসের গবেষণা ফেলো আবদুর রাজ্জাক সরকার বলেন, ২০১৭ সালের একটি গবেষণায় দেখা গেছে, তখন ৮ লাখ মানুষকে কিডনি ডায়ালাইসিস সেবা নিতে হতো। যার মধ্যে ৩০ হাজার এ ডায়ালাইসিস করাতে সক্ষম ছিলেন। কিডনি ডায়ালাইসিস সেবা মূলত শহরকেন্দ্রিক। বিশেষ করে ঢাকায়। ফলে জেলা পর্যায় থেকে রোগীদের ভোগান্তি হয়। তিনি বলেন, চিকিৎসার সুযোগ দিতে জেলা পর্যায়ের হাসপাতালে চালু করা এবং মানুষের সামর্থ্যের মধ্যে আনা প্রয়োজন। বেসরকারি হাসপাতালে ডায়ালাইসিস সেবায় ভর্তুকির ব্যবস্থা করা যেতে পারে। আবদুর রাজ্জাক কিডনি ডায়ালাইসিসের রোগীদের সামাজিক নিরাপত্তা খাত ও বিমার আওতায় আনার পরামর্শও দেন।