অনলাইন ডেস্ক
ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে পাচার করা অর্থ ফিরিয়ে আনতে আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান নিয়োগ দিতে যাচ্ছে অন্তর্বর্তী সরকার। যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা ও সুইজারল্যান্ডের পৃথক এসব প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে শিগগির প্রয়োজনীয় প্রক্রিয়া চূড়ান্ত হবে। অর্থ উদ্ধারে সহযোগিতা প্রদানের লক্ষ্যে যুক্তরাজ্যের একটি প্রতিনিধিদল সম্প্রতি বাংলাদেশ ঘুরে গেছে। সুইজারল্যান্ডের একটি প্রতিনিধিদলও বাংলাদেশে আসছে।
যেসব প্রতিষ্ঠান বা এজেন্সি নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে তাদের পাচার করা অর্থ উদ্ধারে তথ্যের অনুসন্ধান, অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া, সংশ্লিষ্ট দেশের যথাযথ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করা এবং প্রয়োজনে আইনি লড়াই করবে। প্রাথমিকভাবে সরকারের পক্ষ থেকে চুক্তিবদ্ধ এজেন্সিকে দেশ থেকে টাকা পাচার করেছেন এমন সন্দেহভাজনদের নাম-ঠিকানা সরবরাহ করা হবে। ঐসব ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের বিষয়ে পাচার করা অর্থসম্পদের যেসব তথ্য সরকারের কাছে রয়েছে সেগুলো এজেন্সিকে দেওয়া হবে। এর ভিত্তিতে এজেন্সিগুলো প্রাথমিক অনুসন্ধান শুরু করবে। তাদের অনুসন্ধানে পাচার হওয়া সম্পদের তথ্য নিশ্চিত করা গেলে সে বিষয়ে এজেন্সি ঐ দেশের যথাযথ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেবে। রবিবার প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকে ১২ জন অর্থ পাচারকারীকে চিহ্নিত করার কথা জানিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর।
গভর্নর জানান, ব্যাংক থেকে টাকা লুটপাট করেছেন এমন ১২ জন ‘অলিগার্ল’কে চিহ্নিত করা হয়েছে। এরা কীভাবে টাকা নিয়েছেন, সেগুলো বের করতে আমরা বিদেশি বিশেজ্ঞদের সহযোগিতা নিচ্ছি। আন্তর্জাতিক প্রটোকল মেনে পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনার চেষ্টা করা হচ্ছে। পাচার হওয়া অর্থ উদ্ধারে সহযোগিতা প্রদানের লক্ষ্যে যুক্তরাজ্যের একটি প্রতিনিধিদল বাংলাদেশ ঘুরে গেছে, সুইজারল্যান্ডের একটি প্রতিনিধিদলও বাংলাদেশে আসছে।
দেশের শীর্ষ পর্যায়ের ১০ শিল্পগোষ্ঠীর অবৈধ অর্থ অর্জন, কর ফাঁকি ও অর্থ পাচার খতিয়ে দেখতে এরই মধ্যে যৌথ তদন্ত শুরু করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক), পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) এবং কাস্টমস গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর। এর মধ্যে ছয়টি গ্রুপের তদন্তে নেতৃত্ব দিচ্ছে দুদক ও চারটির নেতৃত্ব দিচ্ছে সিআইডি। তদন্ত শেষে এসব প্রতিবেদন আদালতে দাখিল করবে সংস্থা দুটি। দুদক ও সিআইডির যৌথ এই তদন্ত সমন্বয় করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আর্থিক গোয়েন্দা শাখা বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ)। আর তাদের আইনি সহায়তা দিচ্ছে অ্যাটর্নি জেনারেলের কার্যালয়।
যে ১০ শিল্পগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু হয়েছে সেগুলো হলো এস আলম, বেক্সিমকো, নাবিল, সামিট, ওরিয়ন, জেমকন, নাসা, বসুন্ধরা, সিকদার ও সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরীর আরামিট গ্রুপ। এর মধ্যে সিআইডি তদন্ত করছে এস আলম, বেক্সিমকো, নাবিল ও জেমকন গ্রুপের আর্থিক অনিয়ম ও অর্থ পাচারের বিষয়ে। বাকি ছয়টির তদন্তে নেতৃত্ব দিচ্ছে দুদক।
দুদক কর্মকর্তা জানান, অর্থ পাচারের ক্ষেত্রে মূলত ট্রেড বেইজড মানিলন্ডারিং বা বাণিজ্যের আড়ালে অর্থ পাচার পদ্ধতি বেশি ব্যবহার হয়ে থাকে। এই প্রক্রিয়ায় বৈধ বাণিজ্যের আড়ালে অবৈধ অর্থ পাচার করা হয়, যা শনাক্ত করা বেশ কঠিন। অভিযোগ তদন্ত করে আইনি ব্যবস্থার গ্রহণের মাধ্যমে যে দেশে অর্থ পাচার করা হয়েছে, সেই দেশ থেকে অর্থ উদ্ধারের প্রক্রিয়া শুরু করা হবে। গন্তব্য দেশে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ ছাড়া পাচারের অর্থ ফেরত পাওয়ার সম্ভাবনা কম। এর জন্য কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের অর্থ পাচারের অভিযোগ সে দেশের আদালতে প্রমাণিত হতে হবে এবং রায়ে পাচার করা অর্থ ফিরিয়ে আনার নির্দেশনা থাকতে হবে। এর পর যে দেশে অর্থ পাচার হয়েছে সেই দেশের আইনি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে মিলে উদ্যোগ নিতে হয় অর্থ ফিরিয়ে আনার।
বাংলাদেশের অর্থনীতিতে অনিয়ম ও দুর্নীতি তদন্তে অন্তর্বরর্তীকালীন সরকার গঠিত শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির হিসেবে গত ১৫ বছরে শেখ হাসিনা সরকারের আমলে বাংলাদেশ থেকে গড়ে প্রতি বছর ১৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বিদেশে পাচারের তথ্য উঠে এসেছে। সেই হিসেবে গত ১৫ বছরে পাচার হয়েছে ২৪০ বিলিয়ন বা ২ লাখ ৪০ হাজার কোটি মার্কিন ডলার। ইতিমধ্যে পাচার হওয়া অর্থ ফেরাতে কাজ শুরু হয়েছে। প্রধান উপদেষ্টা যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, সিংগাপুর, ইউরোপী ইউনিয়ন, জাতিসংঘসহ বিভিন্ন দেশ ও সংস্থার প্রতিনিধিদের সঙ্গে এ বিষয়ে আলোচনা করেছেন এবং তাদের কাছ থেকে আশ্বাস মিলেছে। কূটনৈতিক পর্যায়েও আলোচনা হচ্ছে।
দুদকের অনুসন্ধনে উঠে এসেছে, অর্থ পাচারের প্রধান গন্তব্যগুলোর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, সংযুক্ত আরব আমিরাত, সিংগাপুর, মালয়েশিয়া ও সুইজারল্যান্ড উল্লেখযোগ্য। এছাড়া ইংল্যান্ড, দুবাই, কানাডা, ভারত, মালয়েশিয়া, সাইপ্রাস, হংকংসহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে সবচেয়ে বেশি অর্থ পাচার হয়েছে।
পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনাসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থা এফবিআই, ইউনাইটেড ন্যাশনস অফিস ফর ড্রাগস অ্যান্ড ক্রাইম (ইউএনওডিসি), ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ), বিশ্ব ব্যাংক ও এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) সঙ্গে দুদকের বৈঠক হয়েছে। পাচার হওয়ার অর্থ উদ্ধার ও তথ্য সংগ্রহে সহায়তা চেয়ে বিভিন্ন দেশে ৭১টি চিঠি (এমএলএআর) পাঠিয়ে ২৭টির জবাব পেয়েছে দুদক।