নিজস্ব প্রতিবেদক
‘স্টুডেন্টস ফার্স্ট’ ও ‘বাংলাদেশ ফার্স্ট’ স্লোগান সামনে রেখে এবং ছাত্র-নাগরিকের স্বার্থ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে আত্মপ্রকাশ করেছে ‘গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদ’ নামে নতুন ছাত্র সংগঠন। কিন্তু কমিটি ঘোষণার শুরুতেই তারা নিজেদের মধ্যে সংঘর্ষে জড়িয়েছেন। দুই পক্ষের মধ্যে হাতাহাতি ও মারামারির মধ্য দিয়ে অবশেষে আত্মপ্রকাশ করেছে ছাত্রদের এই নতুন ছাত্র সংগঠন। নতুন এ সংগঠন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাবেক সমন্বয়কদের নিয়ে গঠিত হয়েছে। সংগঠনটির কেন্দ্রীয় আহ্বায়ক হয়েছেন আবু বাকের মজুমদার। গতকাল বুধবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর ক্যান্টিনে সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে আত্মপ্রকাশ সংগঠনের কমিটিতে পদ পাওয়া-না পাওয়া নিয়ে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যে কয়েক দফা হাতাহাতি ও মারামারির ঘটনা ঘটে। ধস্তাধস্তি, পরনের কাপড় ছিঁড়ে ফেলা- ইত্যাদি সঙ্ঘাতের মধ্য দিয়েই নতুন সংগঠন গড়া হলো। ছাত্র সংগঠনটির সদস্যসচিব হিসেবে জাহিদ আহসান, মুখ্য সংগঠক হিসেবে তাহমিদ আল মুদাসসির দায়িত্ব পেয়েছেন।
নতুন সংগঠনের কেন্দ্রীয় কমিটির মুখ্য সংগঠক করা হয়েছে ঢাবি শিক্ষার্থী তাহমিদ আল মুদাসসির চৌধুরীকে এবং মুখপাত্র হয়েছেন আশরেফা খাতুন। সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়কের দায়িত্বে আছেন তৌহিদ মোহাম্মদ সিয়াম এবং সিনিয়র সদস্যসচিব হয়েছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক রিফাত রশীদ।
সংগঠনটির ঢাবি শাখার আহ্বায়ক হয়েছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম আহ্বায়ক আবদুল কাদের, যিনি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় ৯ দফা কর্মসূচি ঘোষণা করে আলোচনায় আসেন। কাদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ইনস্টিটিউটের ২০১৮-১৯ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী। তার সঙ্গে সদস্যসচিব হিসেবে আছেন ঢাবির একই শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী মহির আলম।
ঢাবি শাখার মুখ্য সংগঠক হিসেবে দায়িত্ব পেয়েছেন হাসিব আল ইসলাম এবং মুখপাত্র হয়েছেন রাফিয়া রেহনুমা হৃদি। এছাড়া লিমন মাহমুদ হাসানকে সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক এবং আল আমিন সরকারকে সিনিয়র সদস্য সচিব করা হয়েছে।
সূত্রের দাবি, ২৮ ফেব্রুয়ারি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কদের সম্ভাব্য আত্মপ্রকাশ করা দলে পদ-পদবি না পাওয়ায় বৈষম্যের অভিযোগ তুলে কয়েকজন সমন্বয়ক পৃথক ছাত্র সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন। নতুন ছাত্র সংগঠনের নাম ঘোষণার সময় বৈষম্যের অভিযোগে হাতাহাতির ঘটনা ঘটে।
এদিকে নতুন এ ছাত্র সংগঠনে পর্যাপ্ত সংখ্যক পদ সৃষ্টি করা হয়নি বলে অভিযোগ করেন প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল শিক্ষার্থী। তারা শুরু থেকে এ কমিটির বিরোধিতা করেন। এ নিয়ে গতকাল বিকেল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত দুই দফায় দুপক্ষের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। বেলা ৩টায় মধুর ক্যান্টিনে সংবাদ সম্মেলনের ঘোষণা শুরুর পরই উত্তেজনার সৃষ্টি হয়। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল শিক্ষার্থী নতুন কমিটিতে নিজেদের জন্য পর্যাপ্ত পদ না পাওয়ার অভিযোগ তুলে বিক্ষোভ শুরু করেন।
বিকেল ৪টার পর মধুর ক্যান্টিনে উভয় পক্ষের মধ্যে হাতাহাতির ঘটনা ঘটে। ব্যাপক হট্টগোলের মধ্যেও কমিটি ঘোষণা করেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন অন্যতম সমন্বয়ক ও সামনের সারির যোদ্ধা আবু বাকের মজুমদার। তিনি কমিটি ঘোষণার পর মধুর ক্যান্টিন থেকে বেরিয়ে বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের মল চত্বরের দিকে রওনা দেন। এ সময় প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদবঞ্চিতদের মধ্যে ব্যাপক হাতাহাতি হয়। এর রেশ ধরে সন্ধ্যায় মল চত্বরে সংঘর্ষের ঘটনাও ঘটে। এতে আহত হন কয়েকজন শিক্ষার্থী। তবে কেউই গুরুতর আহত হননি।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে বৈষম্যের অভিযোগ তুলে বেরিয়ে নতুন ছাত্র সংগঠন আসার ঘোষণা দেন সাবেক সমন্বয়ক আবু বাকের মজুমদার। কিন্তু এখানেও শিক্ষার্থীরা বৈষম্যের অভিযোগ তুলে বিক্ষোভ করেন। সাবেক সমন্বয়ক রিফাত রশিদকে কেন্দ্রীয় গুরুত্বপূর্ণ পদ না দেয়ায় তারা বিক্ষোভ করেন। এছাড়াও তাদের ক্ষোভ রয়েছে উত্তরা পূর্ব ও পশ্চিমের কমিটি না দেয়ায়। শিক্ষার্থীরা ‘আমার সোনার বাংলায়, বৈষম্যের ঠাঁই নাই’, ‘দিয়েছি তো রক্ত, আরো দেবো রক্ত’, ‘জাস্টিস জাস্টিস, উই ওয়ান্ট জাস্টিস’, ‘রিফাত রশিদের ভয় নাই, রাজপথ ছাড়ি নাই’ ইত্যাদি সেøাগান দেন। নতুন ছাত্র সংগঠনের আত্মপকাশের সংবাদ সম্মেলনের সময় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষার্থী সেখানে বৈষম্যের অভিযোগ তোলেন। তাদের দাবি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্রিক কমিটি তারা মেনে নেবেন না। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় এবং সারা দেশের শিক্ষার্থীদের কমিটিতে রাখার দাবি জানান তারা।
নতুন এ সংগঠনে অপেক্ষাকৃত যোগ্যদের তুলনামূলক পেছনের দিকে রাখা হয়েছে বলেও অভিযোগ করেন অনেক শিক্ষার্থী। এমনকি এ কমিটি নিয়ে হতাশা প্রকাশ করেছেন স্বয়ং বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মুখপাত্র উমামা ফাতেমা। তিনি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে লিখেন- পুরান রাজনৈতিক বন্দোবস্ত…ঢাবির পক্ষে আর রাজনৈতিক বিশ্ববিদ্যালয়ের স্তর থেকে উত্তরণ সম্ভব হলো না। ঢাবির ঐতিহাসিক পরাজয়।
নতুন নেতাদের পরিচয় : বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদের কেন্দ্রীয় আহ্বায়কের দায়িত্ব পাওয়া আবু বাকের মজুমদার বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের ২০১৯-২০ সেশনের শিক্ষার্থী। যে ছয়জন সমন্বয়ককে ডিবি হেফাজতে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল, তার মধ্যে তিনি একজন। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আগে তিনি আখতার হোসেন ও নাহিদ ইসলামের নেতৃত্বে গঠিত গণতান্ত্রিক ছাত্রশক্তির ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সদস্যসচিব ছিলেন। এই কমিটির আহ্বায়ক ছিলেন অন্তর্র্বতী সরকারের উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ।
কেন্দ্রের সদস্যসচিব পদে আসা জাহিদ আহসান বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে দফতর সেলের সম্পাদক ছিলেন। জুলাই অভ্যুত্থানে তিনি সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছেন। এ ছাড়া আবরার ফাহাদের স্মরণে আয়োজিত অনুষ্ঠানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিতে হামলার শিকার হন তিনি। অন্তর্র্বতী সরকারের ক্রীড়া উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদের সঙ্গে তাকেও গ্রেফতার করা হয়। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের ২০১৮-১৯ সেশনের শিক্ষার্থী।
সংগঠনটির মুখ্য সংগঠক পদে এসেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশ্বধর্ম ও সংস্কৃতি বিভাগের শিক্ষার্থী তাহমিদ আল মুদাসসির চৌধুরী। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিতর্ক সংসদের সহ-সভাপতি। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে সমন্বয়ক হিসেবে ভূমিকা রাখেন। তিনি ‘একতার বাংলাদেশ’ নামে একটি প্ল্যাটফর্মের মুখপাত্র হিসেবেও কাজ করেন। অভ্যুত্থানের পর গত কয়েক মাসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সংগঠিত একাধিক রাজনৈতিক কর্মকা-ের সঙ্গে তিনি সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন।
সংগঠনটির মুখপাত্র হিসেবে দায়িত্বে আসা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শামসুন্নাহার হলের শিক্ষার্থী আশরেফা খাতুন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের ২০১৮-১৯ সেশনের শিক্ষার্থী। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে তিনিও সমন্বয়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
এ ছাড়াও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আহ্বায়ক পদে এসেছেন সমাজ কল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের ২০১৮-১৯ সেশনের শিক্ষার্থী আব্দুল কাদের। আব্দুল কাদের বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। যখন প্রথম সারির সমন্বয়কদের ডিবি হেফাজতে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়, তখন তিনি সামনে এগিয়ে আসেন এবং গণ-অভ্যুত্থানের ৯ দফা ঘোষণা করেন; যা আন্দোলনকে এক দফার দিকে নিয়ে যায়। এর আগে তিনি গণতান্ত্রিক ছাত্রশক্তি ও ছাত্র অধিকার পরিষদের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সদস্যসচিব পদে আসা মহির আলম গণিত বিভাগের শিক্ষার্থী। তিনি জুলাই অভ্যুত্থানে সক্রিয় ছিলেন। এ ছাড়া মুখ্য সংগঠক পদে আসা হাসিব আল ইসলাম সমন্বয়ক হিসেবে জুলাই অভ্যুত্থানে ভূমিকা রাখেন। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষের সমাজ বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী। এর আগে তিনি আখতার হোসেনের নেতৃত্বে গঠিত গণতান্ত্রিক ছাত্রশক্তির সক্রিয় সদস্য ছিলেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মুখপাত্র হিসেবে আসা বাংলাদেশ কুয়েত-মৈত্রী হলের শিক্ষার্থী রাফিয়া রেহনুমা হৃদি সমন্বয়ক হিসেবে জুলাই অভ্যুত্থানে ভূমিকা রাখেন। এ ছাড়া নারীদের হলে আবাসন সঙ্কট নিরসনসহ একাধিক আন্দোলনে তিনি সক্রিয় ভূমিকা রাখেন। তিনিও সমাজ বিজ্ঞান বিভাগের ২০১৯-২০ সেশনের শিক্ষার্থী।