‘টাকার পিছে দুনিয়া ঘোরে, আমি ঘুরলে দোষ কি’ রুনা লায়লার গাওয়া ঢাকাই সিনেমার এই গানটি যেন দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর ‘চেতনা’ হয়ে গেছে। রাজনৈতিক দল মানেই জনগণের সেবা অজুহাতে টাকা কামানোর মেশিন। আদর্শ-নীতি-নৈতিকতার বদলে কিছু দলের মিশন-ভিশন হচ্ছে ওমর খৈয়ামের কবিতা ‘নগদ যা পাও হাত পেতে নাও, বাকির খাতায় শূন্য থাক; দূরের বাদ্য কাজ কী শুনে, মাঝখানে যে বেজায় ফাঁক’ এর মতো। টেন্ডারবাজি-চাঁদাবাজি-নিয়োগ বাণিজ্য-টাকার বিনিময়ে হাসিনার অলিগার্ক ব্যবসায়ীদের ঢাল হিসেবে ব্যবহৃত হওয়ার প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে। সোশ্যাল মিডিয়া খুললেই এসব নিয়ে হৈচৈরৈরৈ, চেঁচামেচি, অভিযোগ পাল্টা অভিযোগ, আলোচনা-সমালোচনা আর বিতর্ক। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, পরিস্থিতি এমন হয়েছে যে কয়েক মাস আগেও যারা রিক্সা ভাড়া মেটাতে পারতেন না তারা এখন দামী গাড়িতে চলাফেরা করেন। মেসে থাকতেন তারা এখন দামি ফ্লাটে বসবাস করেন। আর বিএনপির কিছু সিনিয়র নেতা পুরনো শকুন আওয়ামী লীগের মতোই খামচে ধরেছে পরিবহনসহ কয়েকটি সেক্টর। এ জন্যই কি মানুষ রাজপথ রক্তে রঞ্জিত করে ৫ আগষ্ট বিপ্লব ঘটিয়েছে?
ছাত্রজনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা পালানোর পর নতুন রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) যুগ্ম সদস্য সচিব গাজী সালাউদ্দীন তানভীরের জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) ৪০০ কোটি টাকা ‘বাণিজ্য’ নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় হৈহৈরৈরৈ পড়ে গেছে। রমজান মাসে ছাত্র শিবিরের ৯০ লাখ টাকার ইফতার ঘোষণার পর শিবিরের টাকার উৎস নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে ছাত্রদল; পাল্টা ছাত্রদলের চাঁদাবাজীর ফিরিস্তি দিচ্ছে ছাত্র শিবির। রাজনৈতিক দল জামায়াতের বিরুদ্ধে ব্যাংক-বীমা-ইন্সুরেন্স দখল, হাসিনার অলিগার্ক বসুন্ধরা থেকে অর্থ নেয়ার অভিযোগ, এনসিপির হামিম গ্রুপ থেকে কোটি টাকা নিয়ে সমাবেশ করার অভিযোগ, রূপায়ন টাওয়ারে অফিস ভাড়া এবং বসুন্ধরা গ্রুপের ঢাল হিসেবে ব্যবহৃত হতে নির্বাচনে এনসিপিকে সব খবর দেয়ার প্রতিশ্রুতি, বিএনপির চাঁদাবাজী, পরিবহন সেক্টর দখল ইত্যাদি নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় চলছে তুমুল বিতর্ক। শেখ হাসিনার ১৫ বছর আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগ রাজনীতির নামে টাকা কামানোর মেশিনে পরিণত হয়েছিল। তারা সর্বত্রই লুটপাট করে এখন করুণদশায়। আমজনতার ‘হাসিনার টাকা কামানোর মেশিনের রাজনৈতিক সংস্কৃতি’ পরিবর্তনের লক্ষ্যে ছাত্রজনতার অভ্যুত্থানে রাজপথে নেমে এসেছিল। হাসিনা পালিয়েছে, তার অলিগার্কদের আস্ফালন নেই। কিন্তু এখন কেন রাজনীতি টাকা কামানোর মেশিন হবে? হাসিনার অলিগার্ক অসৎ ব্যবসায়ীরা যদি নতুন রাজনৈতিক দল এনসিপি, বিএনপি, জামায়াতসহ রাজনৈতিক দলগুলোকে ফান্ড সহায়তা দিয়ে ‘পাপ মোচন’ করার সুযোগ পায় তাহলে বেক্সিমকোর মালিক জেলে কেন?
রাজনীতি হল ন্যায়নীতি ও আদর্শ অবলম্বন করে জনগণের কল্যাণ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য নিয়ে কাজ করা। উইলিয়াম কেরি তার বাংলা অভিধানে রাজনীতি শব্দের অর্থ করেছেন ‘রাজার ন্যায়বিচার’। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র থাকলে রাজনীতি থাকবেই। ঐতিহাসিক প্রয়োজনে ১৯০৬ সালে মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠা হয়েছিল। মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীও ১৯৪৯ সালে আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠন করেন। শেখ মুজিবের জুলুম-দুর্নীতির প্রতিবাদে ১৯৭২ সালে জাসদ প্রতিষ্ঠা হয়। একদলীয় বাকশালের গর্ত থেকে রাজনীতিকে মুক্ত করতে জিয়াউর রহমান ১৯৭৮ সালে প্রতিষ্ঠা করেন বিএনপি। প্রতিটি দল প্রতিষ্ঠার সময় আদর্শ-দর্শন-উদ্দেশ্য-লক্ষ্য জনসম্মুখে তুলে ধরে জনগণকে কাছে টানার চেষ্টা করেন। মেধাবী শিক্ষার্থীদের সমন্বয়ে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের জাসদ গঠন করা হলেও নেতাদের হঠকারিতায় দলটি জনমনে প্রত্যাশিত জায়গা পায়নি। তবে অন্যান্য দলগুলো ব্যাপক জনসমর্থন পায়। হাসিনা পালানোর পর দেশে ১৫টি নতুন রাজনৈতিক দল আত্মপ্রকাশ করেছে। কোনো দল তেমন আলোচনায় না এলেও ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেয়া জাতীয় নাগরিক পার্টি গণমাধ্যমে সাড়া ফেলে এবং ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা ও বিতর্ক শুরু হয়। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রচ্ছন্ন সহায়তায় নতুন এ দল গঠনের অভিযোগ উঠার পাশাপাশি দলটির কয়েকজন নেতার বিরুদ্ধে বিতর্কিত ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে সহায়তা নেয়া, প্রশাসনে প্রভাব খাটিয়ে নিয়োগ-টেন্ডার বাণিজ্যের অভিযোগ উঠে। প্রশ্ন হচ্ছে নতুন দল রাজনীতিতে নতুন কি ‘বন্দবস্তÍ’ দিচ্ছে? নাকি তরুণ নেতারা মন্ত্রী-এমপি হওয়ার বাসনায় মরিয়া? সোশ্যাল মিডিয়ায় এ বিতর্ক রয়েছে নতুন দলের নেতাদের বেশির ভাগই আগে শিবির ও নিষিদ্ধ ছাত্রলীগে ছিলেন।বিস্তারিত