নিজস্ব প্রতিবেদক
৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর থেকেই নানা কারণে আলোচনা-সমালোচনায় আছে দলটি। আগস্টের শুরুতে শেখ হাসিনার ক্ষমতা ছেড়ে ভারতে ‘পালিয়ে যাওয়া’র পর থেকেই জুলাই আন্দোলনে হাজারের বেশি হত্যাকাণ্ডের দায়ে অভিযুক্ত দলটির শীর্ষ নেতারা। অনেকে গ্রেপ্তার হয়ে বিচারের মুখোমুখি হচ্ছেন, অনেকে গোপনে দেশ ছেড়ে বিদেশে অবস্থান করছেন। রাজনীতির ময়দান থেকে তো বটেই অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকেও সব সময় কড়া বার্তা উচ্চারিত হচ্ছে দলটির অভিযুক্ত নেতাদের প্রতি। দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) অনুসন্ধান ও তদন্তে বের হচ্ছে নেতাদের বিপুল ‘অবৈধ সম্পদের’ খোঁজ। অনেকেই আটকাচ্ছেন দুদকের মামলার জালে। এর আগেই জুলাই হত্যার ঘটনায় দেশজুড়ে শত শত মামলা দায়েরের পর গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বিচারের মুখোমুখিও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা ও তার পরিবার এবং দলটির কেন্দ্রীয় অনেক নেতা। হুলিয়া মাথায় নিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন দলটির সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরসহ অনেকে। সরকারের পক্ষ থেকে শেখ হাসিনাকে ফেরত চেয়ে চিঠিও দেওয়া হয়েছে ভারত সরকারের কাছে। এর মধ্যে আওয়ামী লীগের সরকার পতনের ৬ মাস পূর্তির দিনে শেখ হাসিনা দলটির প্রবাসী নেতাদের সঙ্গে কথা বলার কারণে রাজধানীর ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধুর ভবন, জাদুঘর, শেখ হাসিনার বাসভবনসহ একাধিক স্থাপনায় হামলা চালিয়েছে ছাত্র-জনতা। এর ভেতরেই রাজনীতিতে যখন সংস্কার আর নির্বাচন ইস্যু নিয়ে বড় দলগুলোর সঙ্গে ছাত্রদের দলের মত-পার্থক্য দেখা দিয়েছে, তখন আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে ফিরে আসার আলোচনা আবারও উত্তাপ ছড়াচ্ছে রাজনীতির মাঠে।
এ আলোচনা প্রকাশ্যে আসে গত বৃহস্পতিবার রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের প্রতিনিধি দলের আলোচনায় প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহম্মদ ইউনূসের করা একটি মন্তব্যকে ঘিরে। তিনি সেখানে স্পষ্টভাবে জানিয়ে দেন ‘অন্তর্বর্তী সরকারের আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার কোনো পরিকল্পনা নেই।’ আর এরপর থেকেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাসহ বেশ কিছু ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীদের এর প্রতিবাদে মিছিল হয়েছে। তারা প্রধান উপদেষ্টার এ মন্তব্য প্রত্যাহারের দাবি জানাচ্ছেন।
তবে বৃহস্পতিবার মধ্যরাতে বিস্ফোরক মন্তব্য করেন জাতীয় নাগরিক পার্টির দক্ষিণাঞ্চলের সমন্বয়ক হাসনাত আব্দুল্লাহ ও সরকারের স্থানীয় সরকার, সমবায় এবং যুব ও ক্রীড়া উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া। তারা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে দেওয়া স্ট্যাটাসে দাবি করেন ভারতের পরিকল্পনায় ‘রিফাইন্ড আওয়ামী লীগ’ নামে আওয়ামী লীগকে পুনর্বাসিত করার ষড়যন্ত্র চলছে। এ বিষয়টি মেনে নেওয়ার জন্য তাদের চাপ প্রয়োগের বিষয়েও বিস্তারিত লেখেন হাসনাত।
এদিকে, যুব ও ক্রীড়া উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছেন, ‘নির্বাচন পিছিয়ে যাবে, অনিশ্চয়তা তৈরি হবে- এসব শঙ্কার কথা বলে কেউ আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের প্রশ্নে জনতার ঐক্যে ফাটল ধরাতে আসবেন না।’
যদিও গতকাল শুক্রবার রাজধানীর উত্তরার দক্ষিণখানে ফায়দাবাদ মধ্যপাড়া হাজী শুকুর আলী মাদ্রাসা সংলগ্ন মাঠে বিএনপি আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেছেন, হত্যা-লুটপাটে জড়িত নয়, এমন কারও নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে বাধা নেই। এ সময় তিনি বলেন, আওয়ামী লীগের রাজনীতি নিয়ে কথা হচ্ছে; কিন্তু বিচার নিয়ে কথা হচ্ছে না। দ্রুত বিচার নিশ্চিত করতে হবে। বিচারের পর আওয়ামী লীগকে জনগণের কাছে ক্ষমা চাইতে হবে। আর জনগণ ক্ষমা করলে আমাদের কোনো আপত্তি নেই।
এরপর গতকাল রাতে সংবাদ সম্মেলন করে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম বলেছেন, গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে আওয়ামী লীগের বিচার চলাকালীন আওয়ামী লীগ এবং ফ্যাসিবাদের সব সহযোগী ব্যক্তি ও সংগঠনের রাজনৈতিক কার্যক্রম নিষিদ্ধ ঘোষণা করতে হবে। নাহিদ ইসলাম বলেন, সম্প্রতি জাতিসংঘের মানবাধিকার-বিষয়ক কমিশনের প্রতিবেদনে সুস্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, জুলাই মাসে বাংলাদেশে সংঘটিত অপরাধ আন্তর্জাতিক অপরাধের শামিল। আওয়ামী লীগের মানবতাবিরোধী অপরাধের ব্যাপারে এত সুস্পষ্ট আন্তর্জাতিক বক্তব্য থাকার পরও বিচারিক প্রক্রিয়ায় ধীরগতি অত্যন্ত নিন্দনীয়। জাতীয় নাগরিক পার্টি অবিলম্বে জুলাই গণহত্যাসহ বিগত ফ্যাসিবাদী রেজিমের সংঘটিত গুম ও বিচার-বহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের বিচারে দৃশ্যমান অগ্রগতি দেখতে চায়।
এ সময় অন্তর্বর্তী সরকার থেকে সম্প্রতি পদত্যাগ করা এই উপদেষ্টা বলেন, ‘অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান মন্তব্য করেছেন ‘আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের কোনো পরিকল্পনা সরকারের নেই।’ আমরা তার এ বক্তব্যের নিন্দা জানাই। আওয়ামী লীগ কর্তৃক সংঘটিত পিলখানা হত্যাকাণ্ড, শাপলা হত্যাকাণ্ড, আগ্রাসন, বিগত আন্দোলনের হত্যাকাণ্ড, গুম, ক্রসফায়ার, ভোট ডাকাতিসহ জুলাই হত্যাকাণ্ডের বিচার প্রশ্নে কার্যকর অগ্রগতি দৃশ্যমান হওয়ার আগে রাষ্ট্রের দায়িত্বশীল পথ থেকে এ ধরনের বক্তব্য অনাকাঙ্ক্ষিত।’
ফলে আলোচনায় আবার এসেছে আওয়ামী লীগ কি কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব বদল করে অভিযোগ নেই এমন নেতাদের দিয়ে দলকে নতুন করে পুনর্গঠন করে রাজনীতিতে আসতে চাইছে? হাসনাতের দেওয়া স্ট্যাটাসে পরিষ্কার, ‘সাবের হোসেন চৌধুরী, শিরিন শারমিন, তাপসকে সামনে রেখে এই পরিকল্পনা সাজানো হচ্ছে।’ হাসনাত আব্দুল্লাহ আরও বলেছেন, ‘একটি বিরোধী দল থাকার চেয়ে একটি দুর্বল আওয়ামী লীগসহ একাধিক বিরোধী দল থাকা’র প্রস্তাব পেয়েছেন তারা।
এ বিষয়ে এনসিপির এই নেতাসহ তার দল আপত্তি জানালেও দেশের অন্যতম বৃহৎ রাজনৈতিক দল বিএনপি ‘জুলাই বিপ্লবের’ পর থেকেই বলে আসছে আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধের বিষয়ে তাদের কোন পরিকল্পনা নেই, দাবিও নেই। এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে আদালত ও দেশের জনগণ। আর রিজভী বলেছেন, যদি নির্দোষ নেতারা আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে আসেন তাহলে তাদের রাজনীতিতে বাধা নেই।
লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে, অন্তর্বর্তী সরকার এর আগে গত ২৩ অক্টোবর আওয়ামী লীগের ভ্রাতৃপ্রতীম ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ করে প্রজ্ঞাপন জারি করলেও আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার কোন সিদ্ধানন্তের কথা জানায়নি। বরং ড. ইউনূস একাধিক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, চলমান বিচারগুলো শেষ হওয়ার পর তাদের রাজনীতিতে আসতে বাধা নেই।
এদিকে, এরমধ্যেই যদি আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃত্ব পদত্যাগ করে মহান মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দানকারী দলটির নেতৃত্ব অপেক্ষাকৃত নবীন এবং কোন মামলার আসামি নন এমন কারো হাতে তুলে দেন তাহলে তাদের আইনিভাবে রাজনীতির অধিকার কেড়ে নেওয়া সম্ভব হবে কিনা সরকার বা কোন পক্ষের তা নিয়ে বিস্তর আলোচনা এখন হতেই থাকবে। তবে নতুন নেতৃত্ব দিয়ে আওয়ামী লীগের ফেরা না ফেরার আলোচনার মধ্যেই একটা বিষয় পরিষ্কার, আগামীকাল রোববার ঐকমত্য কমিশনের কাছে প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপির সংস্কারের প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা জমা পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই নির্বাচনের সময়ের ব্যাপারটি সুস্পষ্ট হতে থাকবে। কারণ, প্রধান উপদেষ্টার পাশাপাশি ছাত্র উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভুইয়ও বলেছেন ডিসেম্বরের মধ্যেই নির্বাচন হবে, নির্বাচন পেছাবে না।