পাচার অর্থ ফেরতে গতি

পাচার অর্থ ফেরতে গতি

নিজস্ব প্রতিবেদক

 

দেশের অর্থ বিদেশে পাচার করেছেন ফ্যাসিস্ট সরকারের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ তার পরিবারের সদস্যরা। একইসঙ্গে ফ্যাসিস্ট সরকারের দোসররাও বিপুল পরিমাণ অর্থ বিদেশে পাচার করেছেন। বিষয়টি বাংলাদেশ ব্যাংকের দৃষ্টিগোচর হলেও শুধু শেখ হাসিনার কারণে পাচার করা অর্থ দেশে ফিরিয়ে আনার কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। বরং শেখ পরিবারের অনেক সদস্য এ বিষয়ে সম্পৃক্ত থেকে উৎসাহ জুগিয়েছেন।

ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের পর বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার প্রথম যে কাজটি সম্পন্ন করার উদ্যোগ নেয় তা হলো বিদেশে পাচার করা অর্থ দেশে ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা করা। যে কারণে সরকারের পক্ষ থেকে বেশ কয়েকটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। যার নেতৃত্বে রয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। এ ছাড়াও রয়েছেন বর্তমান বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর। ইতিমধ্যে বিদেশে পাচার করা অর্থ উদ্ধারের জন্য বেশ কয়েকটি মামলা করা হয়েছে। এ ছাড়াও বিদেশি বিশেষজ্ঞের সহায়তা নেওয়া হচ্ছে। এ বিষয়ে বিশ্ব ব্যাংক সহায়তার আশ্বাস দিয়েছে বলে জানা গেছে।

নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে, পুলিশের তদন্ত বিভাগ, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড, দুর্নীতি দমন কমিশন ও বাংলাদেশ ব্যাংকের ফাইন্যান্স ইন্টেলিজেন্স ইউনিট জোরেশোরে কাজ করছে। তদন্তের জন্য ইতিমধ্যে নথিপত্র তৈরি করার উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। যাদের বিরুদ্ধে তদন্ত হচ্ছে এর মধ্যে রয়েছে, শেখ হাসিনার পরিবার, এস আলম গ্রুপ, বেক্সিমকো গ্রুপ, নাবিল গ্রুপ ও নাসা গ্রুপ। এর বাইরেও এসব শিল্পগোষ্ঠীর প্রধানদের ব্যক্তিগত আর্থিক বিষয়গুলো তদন্তের আওতায় আনা হচ্ছে। জানা গেছে, এসব তদন্তের অগ্রগতি নিয়ে প্রধান উপদেষ্টা নিয়মিত সভা করছেন। আগামী ১৬ এপ্রিল আবারও অর্থ পাচার-সংক্রান্ত বড় ধরনের সভা করবেন। এর আগে রোববার পাচারের অর্থ ফেরত আনার বিষয়ে টাস্কফোর্সের সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। যেখানে সাবিক পরিস্থিতি ও হালনাগাদ অর্থ পাচারের উদ্যোগ নিয়ে আলোচনা হয়। গতকালের সভার সভাপতিত্ব করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর।

সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রে জানা গেছে, গতকালের সভায় যেসব তথ্য নিয়ে আলোচনা হয় এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে কোন কোন ব্যাংক থেকে নামে বেনামে অর্থঋণ নেওয়া হয়েছে। আবার এই অর্থের গতিপথ কোন দিকে গেছে। কোন দেশে কী পরিমাণ অর্থ পাচার হয়েছে। এ ছাড়াও দেশের বাইরে কোথায়, কত সম্পদ তৈরি করেছেন পাচারকারীরা। তবে ইতিমধ্যে বিদেশে অর্থ পাচারের ব্যাপারে বেশ কয়েকটি শিল্প গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে বিদেশে অর্থ পাচারের খোঁজ পাওয়া গেছে। একইসঙ্গে দেশে মামলার মাধ্যমে এসব অর্থ জব্দ করার উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। আর মামলাগুলো সংশ্লিষ্ট দেশের আদালতে করা হবে। যদি দেশগুলোর আদালত রায় দেন তা হলে বিদেশের সম্পদ জব্দ করা হবে। পরে বিভিন্ন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে দেশে ফেরত আনা হবে।

জানা গেছে, এস আলম গ্রুপ দেশ থেকে সবচেয়ে বেশি অর্থ পাচার করেছে। নামে বেনামে ২ লাখ কোটি টাকা পাচার করেছে। যেসব ব্যাংকের মাধ্যমে অর্থ পাচার হয়েছে এর মধ্যে রয়েছে, ইসলামী ব্যাংক, ফার্স্ট সিকিউরিটি ব্যাংক, এসআইবিএল, ইউনিয়ন, জনতা ও এক্সিম ব্যাংক। যে পরিমাণ অর্থ ব্যাংক থেকে তোলা হয়েছে ঋণের নামে সেই ঋণ এখন খেলাপিতে পরিণত হয়েছে।

এ বিষয়ে তদন্ত সংশ্লিষ্ট কয়েকজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা জানান, এখন পর্যন্ত ৬টি দেশে তাদের সম্পদ থাকার তথ্য পাওয়া গেছে। তবে আরও খতিয়ে দেখা হচ্ছে। সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরীর ও তার পরিবারের আরমিট গ্রুপের নামে বিভিন্ন দেশে কয়েকশত বাড়ি ও জমির খোঁজ পাওয়া গেছে। একইসঙ্গে এসব সম্পদের জব্দের আদেশ দিয়েছেন আদালত। বেক্সিমোর সালমান এফ রহমানের মোট ঋণের পরিমাণ ৫০ হাজার কোটি টাকা। ইতিমধ্যে এসব তথ্য পাওয়া গেছে তদন্তের ভিত্তিতে। সিকদার গ্রুপ নামে বেনামে বিভিন্ন ব্যাংক থেকে প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকা সরিয়েছে। ওরিয়ন গ্রুপের বেশ কিছু সম্পদ ইতিমধ্যে জব্দের আদেশ দিয়েছেন আদালত। নাসা গ্রুপের বিদেশে বেশ কয়েকটি বাড়ির খোঁজ পাওয়া গেছে। গ্রুপের চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম ইতিমধ্যে আটক হয়েছেন।

পূর্বাচলে নতুন শহর প্রকল্পে একাধিক সরকারি প্লট বেআইনিভাবে নিজেদের নামে বাগিয়ে নিয়েছেন সাবেক প্রধান মন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ তার পরিবারের সদস্যরা। ইতিমধ্যে ১৬ জনের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। একইসঙ্গে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হয়েছে।

অন্যদিকে গত ১১ এপ্রিল চট্টগ্রামে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ কার্যক্রম সম্পর্কিত এক মতবিনিময় সভায় বলেছেন, আমাদের দেশের ব্যাকিং খাতে কতিপয় পরিবার বা গোষ্ঠী মানি লন্ডারিং করে সম্পদ চুরি করে বাইরে নিয়ে গেছে। আমরা সেই সম্পদ ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছি। চট্টগ্রামের কিছু বড় গ্রুপ অন্তত সোয়া লাখ কোটি থেকে দেড় লাখ কোটি টাকা নিয়েছে ব্যাংকিং খাত থেকে। এ ছাড়াও কিছু গ্রুপ ২০ থেকে ৫০ হাজার কোটি টাকা নিয়েছে। সেগুলো আদায় করতে হবে অর্থঋণ আদালতসহ অন্যান্য আইনি প্রক্রিয়ায়।

কিছু দিন আগে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর দেশের বাইরে গিয়েছিলেন। তিনি মূলত গিয়েছিলেন পাচার করা অর্থ দেশে ফেরত আনার প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করতে। ইতিমধ্যে তিনি বেশ কয়েকজন বিশেষজ্ঞের সঙ্গে কথা বলেছেন। তিনি আশা করছেন চলতি বছরের মধ্যে পাচার করা বেশ কিছু পরিমাণ অর্থ দেশে ফেরত আনা সম্ভব হবে।

জাতীয় শীর্ষ সংবাদ