দাজ্জালের আগমন ও পরিণতি

দাজ্জালের আগমন ও পরিণতি

 

 

দাজ্জাল এক মহাপ্রতারকের নাম। শেষ জমানায় তার আবির্ভাব হবে। তার আবির্ভাব অনেক বড় বিপর্যয়ের কারণ হবে। সব নবী-রাসুল তার ফেতনা থেকে উম্মতকে সতর্ক করেছেন। প্রিয় নবী হজরত মুহাম্মদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দাজ্জালের ফেতনাকে সবচেয়ে বড় ফেতনা বলে আখ্যায়িত করেছেন। কেননা অনেক আশ্চর্যজনক কিছু বিষয় মহান আল্লাহ তার দ্বারা ঘটাবেন এবং সে তার সময়কালে মানুষের আকিদায় বড় ধরনের পরিবর্তন ঘটাবে।

দাজ্জাল শব্দটি ‘দাজলুন’ থেকে নির্গত। এর অর্থ হক ও বাতিলের মধ্যে সংমিশ্রণ। এ ছাড়াও ধোঁকা, ষড়যন্ত্র, বাতিলকে সুসজ্জিত করে দেখানো এবং মিথ্যার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন অর্থ দাজ্জাল শব্দের মধ্যে বিদ্যমান রয়েছে। দাজ্জালের গুণবাচক নাম মাসিহ। অপরদিকে হজরত ঈসা (আ.)-এর গুণবাচক নামও মাসিহ। তবে উভয়ের নামের মাসিহ শব্দের মধ্যে অনেক পার্থক্য বিদ্যমান। ‘মাসিহ’-এর সাধারণ অর্থ মুছে দেওয়া বা স্পর্শ করা। মাসিহ শব্দটি দাজ্জালের সঙ্গে যুক্ত করে আনা হয়। বলা হয় ‘মাসিহুদ দাজ্জাল’। আর ঈসা (আ.)-এর সঙ্গে যুক্ত করে আনা হয় না। বলা হয় ‘মাসিহ আলাইহিস সালাম’ কিংবা ‘ঈসা আল-মাসিহ’। অর্থগত দিক দিয়েও উভয়ের মধ্যে পার্থক্য স্পষ্ট। যেমন দাজ্জালের চোখ সমতল বিশিষ্ট হওয়ার দরুণ দাজ্জালকে মাসিহ বলা হয়ে থাকে। পক্ষান্তরে ঈসা (আ.) জন্মগত অন্ধকে হাত বুলিয়ে দিলে দৃষ্টিশক্তি ফিরে পেত বলে তাকেও মাসিহ বলা হয়। তা ছাড়া দাজ্জাল কল্যাণ মুছে দেবে ও অকল্যাণ ডেকে আনবে। আর ঈসা (আ.) অকল্যাণ মুছে দেবেন, কল্যাণ বয়ে আনবেন। (উমদাতুল কারি ১০/২৪২-২৪৩)

দাজ্জালের আবির্ভাব কেয়ামতের বড় আলামত। তার ফেতনা থেকে মহানবী (সা.)-ও খুব সতর্ক করেছেন। নাওয়াস ইবনে সামআন (রা.) বর্ণনা করেন, রাসুল (সা.) একদিন সকালবেলা দাজ্জাল সম্পর্কে আলোচনা করলেন। আলোচনার শুরুতে তিনি দাজ্জালের ব্যক্তিত্বকে তুচ্ছ করে তুলে ধরেন। পরে বেশ গুরুত্ব সহকারে উপস্থাপন করেন। যাতে তাকে আমরা ওই খেজুর বাগানের নির্দিষ্ট এলাকায় (যেখানে তার আবাসস্থল) কল্পনা করতে লাগলাম। এরপর যখন সন্ধায় আমরা রাসুল (সা.)-এর কাছে গেলাম তখন তিনি আমাদের মনোভাব বুঝতে পেরে জিজ্ঞস করলেন, তোমাদের ব্যাপার কী? আমরা বললাম, হে আল্লাহর রাসুল, সকালবেলা আপনি দাজ্জাল সম্পর্কে আলোচনা করলেন। প্রথমে তাকে খুব তুচ্ছ করে তুলে ধরেছেন, যাতে আমরা তাকে খেজুর বাগানের ওই নির্দিষ্ট এলাকায় কল্পনা করতে থাকি (যেখানে সে খুব জাঁকজমক সহকারে অবস্থান করছে)। তখন তিনি বললেন, আমি তো তোমাদের জন্য দাজ্জাল ছাড়া অন্য বিষয়কে অধিকতর আতঙ্কের কারণ মনে করছি। যদি আমি তোমাদের মাঝে বেঁচে থাকা কালীন সে আত্মপ্রকাশ করে তবে আমি তোমাদের সামনে তার সঙ্গে বাকযুদ্ধে অবতীর্ণ হবো। আর যদি সে আত্মপ্রকাশ করে আর আমি তোমাদের মধ্যে না থাকি, তবে প্রত্যেক ইমানদার ব্যক্তি নিজেই তর্কে লিপ্ত হবে এবং আমার পরে মহান আল্লাহই প্রত্যেক মুসলিম ব্যক্তির একমাত্র তত্ত্বাবধানকারী।’ (সহিহ মুসলিম ২৯৭৩)

দাজ্জাল কি মানুষ না জিন? এ বিষয়ে ইসলামি স্কলারদের মতবিরোধ রয়েছে। কেউ কেউ বলেছেন, সে মানুষ। আবার কেউ কেউ বলেছেন, সে হবে শয়তানের অন্তর্ভুক্ত। তবে প্রাধান্যপ্রাপ্ত মত হলো সে মানুষই হবে। নওয়াস ইবনে সামআন (রা.) থেকে বর্ণিত একটি দীর্ঘ হাদিসে এসেছে, ‘সে (দাজ্জাল) হবে একজন যুবক, মাথার চুল কোঁকড়ানো, ফোলা চোখবিশিষ্ট। আমি তাকে (ইহুদি) আবদুল উজ্জা ইবনে কাতানের সঙ্গে তুলনা করতে পারি। সুতরাং যে কেউ তাকে পাবে, সে যেন তার সম্মুখে সুরা কাহাফের শুরুর আয়াতগুলো পাঠ করে।’ (সহিহ মুসলিম ২৯৩৬)

দাজ্জালের পরিচয় বহু হাদিস বিবৃত হয়েছে। মহানবী (সা.) তার পরিচয় প্রদান করে মানুষকে সতর্ক করেছেন যেন কেউ তার খপ্পরে না পড়ে। সে হবে কানা। হুজাইফা (রা.) হতে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘দাজ্জালের বাম চোখ হবে কানা, মাথার কেশ হবে অত্যধিক।’ (সহিহ মুসলিম ২৯৩৪) তার দুচোখের মধ্যখানে কাফের লেখা থাকবে। হাদিসে এসেছে, ‘তার চোখের ওপর নখ পরিমাণ মোটা চামড়া থাকবে, চক্ষুদ্বয়ের মধ্যবর্তী স্থানে লেখা থাকবে কাফের। প্রত্যেক শিক্ষিত ও অশিক্ষিত মুমিন তা পড়তে পারবে।’ (সহিহ মুসলিম ২৯৩৪)

সে নিজেকে মিথ্যা খোদা দাবি করবে। আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসে নবী (সা.) বলেন, ‘আল্লাহতায়ালার পরিচিতি তোমাদের কাছে গোপন নয়। নিশ্চয় আল্লাহ কানা নন। কিন্তু দাজ্জালের এক চোখ কানা হবে। তার এই চোখটি হবে ফোলা আঙ্গুরের মতো।’ (সহিহ বুখারি : ৩৪৩৯)

দাজ্জাল জমিনে চলার সময় তাকে সত্যায়ন করার জন্য মানুষকে আহ্বান করবে। কতক মানুষ তাকে অস্বীকার করবে, তাকে কোনো রকম বিশ্বাস করবে না। ফলে তাদের ভূমি বিরান হয়ে যাবে। ক্ষেত-ফসল সব পুড়ে ছারখার হয়ে যাবে। কোনো কিছু এতে ফলবে না। অপর আরেক দল মানুষের কাছে অতিক্রম করলে তারা তাকে বিশ্বাস করবে এবং তার অনুসরণ করবে। ফলে তাদের ভূমিতে ফল-ফসলে ভরে যাবে। তাদের গবাদি পশুর সংখ্যা বেড়ে যাবে। এভাবে মানুষ তার ফেতনায় পড়ে যাবে। সে জমিনের খনিজ পদার্থ সব বের করে ফেলবে। হাদিসে এসেছে, ‘যে তার অবাধ্যতা করবে তাকে আগুনে ফেলে দেবে, অথচ সেটি প্রকৃতপক্ষে জান্নাত। যে তাকে অনুসরণ করবে তাকে জান্নাতে প্রবেশ করাবে, যা প্রকৃতপক্ষে জাহান্নাম।’ (সহিহ মুসলিম ২৯৩৮)

একটি হাদিসে খোরাসানের প্রসিদ্ধ এলাকা ইসফাহানকে দাজ্জাল আবির্ভাবের স্থান হিসেবে নির্দিষ্ট করা হয়েছে। আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসে নবী কারিম (সা.) বলেন, ‘দাজ্জাল ইসফাহানের ইহুদিয়া থেকে বের হবে।’ (সহিহ মুসলিম ৫২২৮) ইসফাহান বর্তমান ইরানের অন্যতম জনবহুল একটি নগরী, যা জাগ্রোস পর্বতমালার পাদদেশে জায়েন্দে নদীর তীরে অবস্থিত।

এমন কোনো এলাকা থাকবে না যেখানে দাজ্জাল প্রবেশ করবে না। তবে মক্কা ও মদিনায় সে সেখানে প্রবেশ করতে পারবে না। ফেরেশতারা শহর দুটিকে হেফাজত করে রাখবেন। আবু বাকরা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেন, ‘মদিনায় কানা দাজ্জালের ভীতি কখনো পৌঁছবে না। সে সময় মদিনার সাতটি দরজা থাকবে এবং প্রত্যেক দরজায় দুজন করে ফেরেশতা (প্রহরায়) থাকবেন।’ (সহিহ বুখারি ১৮৭৯)

দাজ্জাল বের হয়ে নিহত হওয়া পর্যন্ত ৪০ দিন অবস্থান করবে। এর মধ্যে প্রথম দিন হবে এক বছরের সমান। দ্বিতীয় দিন হবে এক মাসের মতো। তৃতীয় দিন হবে এক সপ্তাহের মতো। বাকি দিনগুলো হবে সাধারণ দিনের মতো। (সহিহ মুসলিম ৭৫৫৮)

দাজ্জালের শেষ সময়ে ঈসা (আ.) পৃথিবীতে অবতরণ করবেন। তার হাতেই দাজ্জাল নিহত হবে। নবী কারিম (সা.) বলেন, ‘ঈসা ইবনে মারিয়াম দামেস্ক শহরের পূর্বে অবস্থিত সাদা মিনারের ওপরে অবতরণ করবেন। অতঃপর তাকে বাবে লুদে পেয়ে হত্যা করবেন।’ (আবু দাউদ ৪১২১) লুদ হচ্ছে মসজিদে আকসার পশ্চিমে উপকূলীয় নগরী তেল আবিব ইয়াফু থেকে রামাল্লাহগামী রাজপথের ধারে ফিলিস্তিনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ নগরী। বর্তমানে ইসরায়েল সেখানে একটি বিশাল বিমানবন্দর বানিয়ে রেখেছে। (সিরাত বিশ্বকোষ ১/৫৪১)

আবু হুরাইরা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেন, মাসিহে দাজ্জাল পূর্বদিক হতে আগমন করে মদিনায় প্রবেশ করতে চাইবে। এমনকি সে উহুদ পাহাড়ের পাদদেশ পর্যন্ত পৌঁছে যাবে। অতঃপর ফেরেশতারা তার চেহারা (গতি) সিরিয়ার দিকে ফিরিয়ে দেবেন এবং সেখানেই সে (ঈসা (আ.)-এর হাতে) ধ্বংস হবে।’ (সহিহ মুসলিম ১৩৮০)

দাজ্জালের আগমন মানব ইতিহাসের এক ভয়ংকর অধ্যায়। তার প্রতারণা, মিরাকল প্রদর্শন এবং ধ্বংসাত্মক প্রভাব থেকে রক্ষা পেতে হলে আমাদের ইমানকে মজবুত করতে হবে। কোরআন-সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরতে হবে, নিয়মিত সুরা কাহফ তেলাওয়াত করতে হবে এবং দাজ্জালের ফিতনা থেকে আল্লাহর কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করতে হবে।  মুহাম্মদ রিফাত হোসেন       আজকের পত্রিকা

ধর্ম শীর্ষ সংবাদ