অনলাইন ডেস্ক
বুধবার দুপুর। পুরান ঢাকার অচেনা পরিচিত ব্যস্ততা ছাপিয়ে যেন হত্যাকাণ্ডের মঞ্চে রূপ নেয় মিটফোর্ড হাসপাতাল প্রাঙ্গণ। দিনের আলোয়, মানুষের ভিড়ে, নিরাপত্তার খুব কাছাকাছিতেই নৃশংসভাবে হত্যা করা হয় চাঁদ মিয়া ওরফে সোহাগকে। সোহাগ হত্যার মিশনে অংশ নেয় ৪০-৫০ জনের একটি দল। লাঠি, রড, পাথর খণ্ড, ইট ও ধারালো অস্ত্রের ভয়াবহ হামলায় মঞ্চস্থ হয় হৃদ কাঁপানো বর্বরতা।
তবু এখানেই শেষ নয়। হাসপাতাল চত্বর থেকে টেনে-হিঁচড়ে মূল সড়কে বের করে আনা হয় সোহাগের মৃত দেহ। শত মানুষের চোখের সামনে মৃতদেহের মুখে ঘুসি, বুকে লাফ ছাড়াও চলে রক্তাক্ত উল্লাস। পাশেই দাঁড়িয়ে থাকা আনসার ক্যাম্প, হাসপাতালের জরুরি বিভাগ সবই ছিল যেন নীরব দর্শক।
ঘটনার শুরুতেই ছিল দু’মুঠো ভাত। মহিনের বন্ধু টিটু বুধবার দুপুরে নিজ হাতে খাওয়ায় সোহাগকে। ব্যবসা নিয়ে দ্বন্দ্বের বিষয়ে শান্তির আশ্বাস দিয়েই খাবার টেবিল থেকে কাঁধে হাত বুলিয়ে নিয়ে আসা হয় হাসপাতাল চত্বরে। এই শান্তির ফাঁদেই শেষবারের মতো বের হন সোহাগ। কেউ ভাবেনি, তার জীবনের শেষ খাবার হবে সেই ‘ভাতের থালা’।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়, সোহাগ হাসপাতালে পা রাখতেই আগে থেকে ওৎ পেতে থাকা দলটি চারদিক থেকে ঘিরে ধরে তাকে। হামলার তীব্রতা ও নিষ্ঠুরতার চিত্র দেখে অনেকেই চোখ ফিরিয়ে নিয়েছেন, এগিয়ে আসেনি কেউই।
শুক্রবার (১১ জুলাই) সরেজমিন স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সোহাগ ছিলেন ‘সোহানা মেটাল’ নামের ভাঙারি দোকানের মালিক। তবে ভাঙারি নয়, তার ব্যবসার আসল সম্পদ ছিল পুরোনো বৈদ্যুতিক তার, বিশেষ করে তামার তার। এই ব্যবসায় চলছিল লক্ষাধিক টাকার লেনদেন। আর সেখানেই চোখ পড়ে চক্রের। মাহমুদুল হাসান মহিন ও সারোয়ার হোসেন টিটু সোহাগের ব্যবসার ৫০ শতাংশ দাবি করে বসে। অথবা নিয়মিত লাভের অর্ধেক চাঁদা দিতে হবে তাদের। সোহাগ অস্বীকৃতি জানালেই শুরু হয় হত্যার পরিকল্পিত ষড়যন্ত্র।
স্থানীয়রা জানান, ঘাতক এবং নিহত উভয়ই ৩০ নম্বর ওয়ার্ডের যুবদলের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। একসময় একসাথে রাজনৈতিক সভা-সমাবেশ করলেও কিছুদিন ধরে তারা প্রতিপক্ষ।
স্থানীয় একটি সূত্র বাংলাদেশের খবরকে জানায়, মহিন যুবদলের সক্রিয় কর্মী। পাশের একটি থানার যুবদলের সাধারণ সম্পাদক পদপ্রার্থীও। স্থানীয়দের অভিযোগ, মহিনের নেতৃত্বেই যুবদলের ছত্রছায়ায় এলাকায় গড়ে উঠেছে একটি ভয়ংকর চাঁদাবাজ সিন্ডিকেট। ব্যবসার ভাগ না দিলে শাস্তি, শত্রু হলেই মৃত্যু।
স্থানীয়রা আরও জানান, সোহাগ হত্যায় অংশ নেয়া ৪০-৫০ জনের দলটিতে থাকা ছেলেগুলো পুলিশকেও ভয় পায় না। কারণ পুলিশ তাদের ধরলেও এক ফোনেই বের হয়ে আসে তারা। তাদের পেছনে রয়েছে বড় ভাই, টাকা আর রাজনীতি।
প্রত্যক্ষদর্শী একাধিক ব্যবসায়ী বাংলাদেশের খবরকে জানান, যেখানে সোহাগকে হত্যা করা হয়, সেখান থেকে আনসার ক্যাম্প মাত্র কয়েক গজ দূরে। জরুরি বিভাগ তার থেকেও কাছাকাছি। তবুও কেউ ঠেকাতে এগিয়ে আসেনি। সবার মধ্যেই ভয় কাজ করছিল, বাঁধা দিতে গেলেই এমন নারকীয় হামলার শিকার হতে পারেন। এছাড়া পরবর্তীতেও এখানে ব্যবসা করাই মুশকিল হতে পারে এমন আতঙ্কে কেউই এগিয়ে আসেনি বরং অনেকেই দোকান বন্ধ করে চলে গেছেন।
এদিকে সোহাগের বোন মঞ্জুয়ারা বেগম ৩০ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেছেন কোতোয়ালি থানায়। মামলায় মাহমুদুল হাসান মহিন, সারোয়ার হোসেন টিটু, মনির ওরফে ছোট মনির, আলমগীর, মনির ওরফে লম্বা মনির, নান্নু, সজীব, রিয়াদ, টিটন গাজী, রাকিব, সাবা করিম লাকী, কালু ওরফে স্বেচ্ছাসেবক কালু, রজব আলী পিন্টু, মো. সিরাজুল ইসলাম, রবিন, মিজান, অপু দাস, হিম্মত আলী ও আনিসুর রহমান হাওলাদারসহ মোট ৩০ জনকে আসামি করা হয়।
এ বিষয়ে কোতয়ালী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ইয়াসিন শিকদার বাংলাদেশের খবরকে বলেন, ‘সোহাগ হত্যাকাণ্ডের মূলহোতা মাহমুদুল হাসান মইন ও হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় জড়িত তারেক রহমান রবিনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাদের কাছ থেকে একটি বিদেশি পিস্তলও উদ্ধার করা হয়েছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘সিসিটিভি ফুটেজ বিশ্লেষণ করা হয়েছে। ফুটেজে থাকা ব্যক্তিদের শনাক্ত করা হয়েছে। এর আগে এই ঘটনায় জড়িত দুইজনকে গ্রেপ্তার করে র্যাব। এ নিয়ে এখন পর্যন্ত চারজনকে গ্রেপ্তার করা হলেও বাকিদের গ্রেপ্তারে অভিযান চলছে।’