অনলাইন ডেস্ক
রাজধানীর মিটফোর্ড হাসপাতালের সামনে প্রকাশ্যে পিটিয়ে ও পাথর মেরে নৃশংস হত্যাকাণ্ড নিয়ে সারা দেশে সমালোচনার ঝড় বইছে। নিহত ব্যবসায়ী লাল চাঁদ ওরফে সোহাগ যুবদলের কর্মী। ব্যবসায়িক দ্বন্দ্ব থেকেই এ হত্যাকাণ্ড বলে দাবি করা হলেও অভিযোগ রয়েছে, হত্যাকারীরাও যুবদলের রাজনীতিতে যুক্ত। ঘটনাটি নিয়ে ক্ষোভ দেখা গেছে খোদ বিএনপিতেও। দলের নেতারা এই ঘটনায় জড়িতদের শাস্তির বিষয়ে একমত পোষণ করেছেন এবং এর পেছনে যদি রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতার প্রমাণ মেলে তবে বড় ধরনের সাংগঠনিক শাস্তির কথাও বলছেন তারা।
তবে হত্যাকাণ্ডটি ঘিরে রাজনৈতিক বিরোধীরা যেভাবে বিএনপিকে নিয়ে প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছেন, তা মোটেও সঠিক নয় বলে মনে করছেন দলটির সিনিয়র নেতারা। যদিও নেতারা বলছেন, ৫ আগস্টের পর বিভিন্ন অপকর্মের সঙ্গে জড়িত চার হাজারের বেশি নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের পরও কেন দখল-চাঁদাবাজির মতো অনৈতিক কর্মকাণ্ডে নেতাদের নাম জড়িয়ে যাচ্ছে, তার কারণ খোঁজার চেষ্টা করা হচ্ছে। এরই আলোকে আগামী নির্বাচন সামনে রেখে দলে ‘ম্যাসিভ’ শুদ্ধি অভিযানের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন বিএনপির হাই কমান্ড।
নিহত সোহাগকে ব্যবসায়ী ও যুবদল কর্মী আখ্যায়িত করে বিএনপির সহযোগী সংগঠন যুবদলের গতকাল এক সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়েছে, তারা এ ঘটনায় পাঁচজনকে সংগঠন থেকে আজীবনের জন্য বহিষ্কার করেছে। তবে একইসঙ্গে তারা অভিযোগ করেছেন, ঘটনার সঙ্গে সরাসরি জড়িত ছিল এমন তিনজনকে আসামির তালিকায় রাখা হয়নি। এদিকে এ ঘটনার পর বিএনপি ও তারেক রহমানকে জড়িয়ে বা ইঙ্গিত করে সামাজিকমাধ্যমে ‘প্রচার’ চলছে, বিক্ষোভ মিছিল হয়েছে। আবার বিভিন্নজনের ফেসবুক স্ট্যাটাস ও মিছিলের স্লোগানে তীব্র প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়েছে বিএনপির ভেতরে।
গত শুক্রবার মিটফোর্ডে হত্যাকাণ্ডের ভিডিও ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ার পর বুয়েট ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘সাধারণ শিক্ষার্থীদের’ নাম ব্যবহার করে যেসব মিছিল হয়েছে সেখান থেকে বিএনপি ও দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বিরুদ্ধে স্লোগান দেওয়া হয়েছে। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাউদ্দিন আহমেদ বলেন, দল থেকে সর্বোচ্চ ব্যবস্থা নেওয়া সত্ত্বেও এ ধরনের প্রচারণা ‘পরিকল্পিত’ ও ‘নোংরা’ রাজনীতির চর্চা। বিএনপির নেতাকর্মীদের অপরাধে জড়িয়ে পড়ার প্রবণতা ক্রমশ বাড়ছে কি না এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি জানিয়েছেন, দলের জেলা থেকে শুরু করে তৃণমূল পর্যায়ে একটি ‘শুদ্ধি অভিযান’ চালানোর সিদ্ধান্ত তারা নিয়েছেন।
বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এ ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করে ঘটনার নিরপেক্ষ ও বিশ্বাসযোগ্য তদন্ত করে প্রকৃত অপরাধীদের আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়ার দাবি জানান।
সংবাদ সম্মেলনে যুবদল সভাপতি আবদুল মোনায়েম মুন্না অভিযোগ করেন, এ ঘটনার সিসিটিভি ফুটেজে যাদের দেখা গেছে, তারা এখনো গ্রেপ্তার হয়নি। সরাসরি ঘটনায় জড়িত তিনজনকে বাদ দিয়ে পুলিশ নিরপরাধ তিনজনকে আসামি করেছে বলেও তিনি অভিযোগ করেন। কারা কেন এ তিনজন আসামিকে বাদ দিয়ে নতুন করে অন্য তিনজনকে আসামি করল এটা জানতে চাই। বুধবারের ঘটনা, প্রচার হলো শুক্রবার। দুদিন পর কেন? সেটাও আমাদের প্রশ্ন। সিসিটিভি ফুটেজে যাদের দেখা যাচ্ছে তাদের সবাইকে গ্রেপ্তার করা উচিত।
হত্যাকাণ্ডটি নিয়ে এনসিপি নেতা সারজিস আলম তার ফেসবুক পোস্টে লিখেছেন ‘আপনার দলের নেতাকর্মী নামক কতিপয় নরপিশাচকে সামলান, তারেক রহমান। যে নিয়মে আওয়ামী লীগের করা হত্যার দায় হাসিনার উপর বর্তায়, সেই একই নিয়মে বিএনপি, যুবদল, ছাত্রদলের নেতাকর্মীদের করা খুনের দায় আপনার উপরে বর্তায়…..।’
প্রসঙ্গত মিটফোর্ডের ঘটনার পর দিন খুলনার দৌলতপুর থানা যুবদলের সাবেক এক নেতাকে গুলি করে ও রগ কেটে হত্যার ঘটনা ঘটেছে। ওইদিনই চাঁদপুর শহরের প্রফেসরপাড়া মোল্লাবাড়ি জামে মসজিদের খতিব মাওলানা নুরুর রহমানকে জুমার নামাজের পর মসজিদের ভেতরেই কুপিয়ে জখম করা হয়েছে।
সালাহউদ্দিন আহমেদ আরো বলেন, বিএনপি একটি বিশাল দল এবং এখানে কারো বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ আসলেই তারা ব্যবস্থা নিচ্ছেন। দল হিসেবে আমাদের যা ব্যবস্থা নেওয়ার এখতিয়ার আছে সেটা আমরা নিচ্ছি। সরকারকেও সহযোগিতা করছি। নিজেরা পুলিশের হাতে দিয়েছি এমন উদাহরণও আছে। দল হিসেবে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়ার দায়িত্ব আমাদের। সেটি তো করছি। সরকারের দায়িত্ব আইনি ব্যবস্থা নেওয়া।
বিএনপির নির্ভরযোগ্য কয়েকটি সূত্র জানায়, মিটফোর্ডের ঘটনার পর হাইকমান্ডের নির্দেশে এরই মধ্যে শুদ্ধি অভিযানের কাজ শুরু হয়ে গেছে। একেবারে ইউনিয়ন থেকে উপজেলা, জেলাসহ সব পর্যায়ের কমিটি যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে। বিশেষ করে প্রতিটি এলাকায় বিএনপি এবং অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনের যেসব নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে জনমনে নেতিবাচক পারসেপশন রয়েছে, সেটি বেশি আমলে নেওয়া হচ্ছে। জনগণ যাদের ওপর রুষ্ট তাদের সতর্ক করাসহ অনেককে দল থেকে বের করে দেওয়া হবে। মোদ্দা কথা, যারা দলের সুনাম নষ্ট করবে এবং দলের জন্য এখন বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে তাদের ছেঁটে ফেলতে হাইকমান্ড এতটুকু দ্বিধা করবে না।
জানতে চাইলে বিএনপির কেন্দ্রীয় যুগ্ম মহাসচিব শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানি বলেন, ‘দল এবং দেশের স্বার্থে বিএনপি যা যা করার তাই করবে। সে ক্ষেত্রে যারা দলের ইমেজ নষ্ট করবে তাদের চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নিতে মোটেই পিছপা হবে না বিএনপি। ধরে নিতে পারেন এ বিষয়ে কাজ চলছে। প্রয়োজনে তালিকা করতে হলে তাও করা হবে। যে কোনো অপকর্ম ও অন্যায়ের সঙ্গে যারা জড়িত হবে তাদের বিরুদ্ধে সঙ্গে সঙ্গে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’