নিজস্ব প্রতিবেদক
পুরান ঢাকার ব্যবসায়ী মো. সোহাগ ওরফে লাল চাঁদকে নৃশংসভাবে হত্যার আলোচনা একেবারে শেষ না হতেই গত শনিবার রাজধানীর গুলশানে সমন্বয়ক পরিচয়ে চাঁদাবাজির ঘটনা প্রকাশ্যে আসে। এ ঘটনার পর দেশজুড়ে তুমুল আলোচনা শুরু হয়েছে। বিভিন্ন মহলে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য নানা উদ্যোগের কথা শোনানো হচ্ছে।
তবে এই আলোচনার মধ্যেও চলছে চাঁদাবাজি। তাতে ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে। চাঁদা না দিলে মব সন্ত্রাস করা হচ্ছে। অনেক স্থানে সমন্বয়ক পরিচয় দিয়ে চাঁদাবাজি চলছে।
স্থানীয় প্রশাসনের অনেকেই আবার ভয়ে তটস্থ রয়েছে বলে তথ্য পাওয়া গেছে। চাঁদা না দিলে অপহরণ করা হচ্ছে টেকনাফসহ বিভিন্ন এলাকায়। এ ক্ষেত্রে আবার রোহিঙ্গারাও বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। সব মিলিয়ে দেশের বেশির ভাগ জেলায় চাঁদাবাজি চলছে বিভিন্ন কৌশলে।
এ অবস্থায় গতকাল সোমবার আইন-শৃঙ্খলাসংক্রান্ত কোর কমিটির বৈঠক শেষে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেছেন, চাঁদাবাজ যত প্রভাবশালীই হোক, কোনো ছাড় দেওয়া হবে না।
গত শনিবার রাতে রাজধানীর গুলশানে সাবেক সংসদ সদস্য (সংরক্ষিত) শাম্মী আহমেদের বাসায় চাঁদার বাকি অর্থ আনতে গিয়ে পুলিশের কাছে ধরা পড়েন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদের চার নেতা। পরে তাঁদের গ্রেপ্তার করে রিমান্ডে নেওয়া হয়। চার আসামির একজন গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য আব্দুর রাজ্জাক রিয়াদ। তিনি সমন্বয়ক পরিচয় দিয়ে নোয়াখালী জেলার সেনবাগের নবীপুরের গ্রামের বাড়িতে পাকা বাড়ি তুলছেন।
স্থানীয়রা বলছেন, রিয়াদ কামিয়েছেন বিপুল অর্থ। তাঁর মতো আরো অনেকের বিপুল অর্থবিত্তের মালিক হওয়া ব্যক্তিদের নিয়ে আলোচনা হচ্ছে বিভিন্ন পর্যায়ে। এ ঘটনায় বিশিষ্ট রাজনীতিকরাও বিস্মিত। তাঁরা নানা প্রশ্ন করছেন। এ ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর গতকাল বলেছেন, ‘পত্রিকায় দেখলাম পাঁচজন সমন্বয়কারীকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। তাঁরা জোর করে একজন সাবেক এমপির কাছ থেকে ৫০ লাখ টাকা চাঁদা আদায় করে নিয়েছেন। এতে বেদনায় একেবারে নীল হয়ে গেছি।’
গত শনিবার রাতে সমন্বয়ক পরিচয়ে চাঁদাবাজির ঘটনা ধরা পড়লে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন প্ল্যাটফর্মের সাবেক মুখপাত্র উমামা ফাতেমা বলেছেন, ‘জুলাই-আগস্ট তো একটি ভিন্ন অভিজ্ঞতা। কেন এটাকে আমি মানি মেকিং মেশিনে পরিণত করব? তবে দুঃখজনকভাবে সেটি হয়েছে। খুবই সাধারণ এবং ধারাবাহিকভাবে হয়ে আসছে।’ গতকাল সোমবার নিজ ফেসবুক থেকে দুই ঘণ্টা ২৪ মিনিটের লাইভ ভিডিওতে তিনি এ কথা বলেন। কথা বলতে বলতে মাঝেমধ্যে তিনি কেঁদেছেন।
গত শনিবারের চাঁদাবাজির ঘটনার পরদিন গত রবিবার রাতে কেন্দ্রীয় ছাড়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সব কমিটি স্থগিত করা হয়েছে। অভিযুক্ত ব্যক্তিদের সংগঠন থেকে বহিষ্কারও করা হয়েছে। জানা গেছে, গত ১৭ জুলাই গুলশানে শাম্মী আহমেদের বাসায় গিয়ে ৫০ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করেন রিয়াদসহ আরো কয়েকজন। তাঁরা নিজেদের সমন্বয়ক পরিচয় দেন। ওই দিন বাসায় ছিলেন শাম্মী আহমেদের স্বামী। তাঁকে ভয়ভীতি দেখিয়ে ৫০ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করেন রিয়াদরা। পরে শাম্মী আহমেদের স্বামী ১০ লাখ টাকা চাঁদাও দেন। এক পর্যায়ে গত শনিবার রাত ৮টায় চাঁদার বাকিটা আনতে যান তাঁরা। পুলিশ আগে থেকে তথ্য পেয়ে ঘটনাস্থল থেকে তাঁদের গ্রেপ্তার করে। এ ঘটনায় শাম্মী আহমেদের স্বামী সিদ্দিক আবু জাফর গুলশান থানায় ছয়জনকে আসামি করে চাঁদাবাজির অভিযোগে মামলা করেছেন।
মামলা, গ্রেপ্তার, বিভিন্নজনের প্রতিক্রিয়ার মধ্যেই দেশের বিভিন্ন স্থানে অবাধে চাঁদাবাজি চলছে। কালের কণ্ঠের প্রতিনিধিরা জানিয়েছেন, সমন্বয়ক পরিচয় দিয়ে ঝিনাইদহ, হবিগঞ্জ, বরিশাল, সিলেটসহ বিভিন্ন স্থানে অনেকেই চাঁদাবাজি করছে।
প্রসঙ্গত, গত ৯ জুলাই ঢাকার মিটফোর্ড (স্যার সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজ) হাসপাতালের সামনের ব্যস্ত সড়কে প্রকাশ্যে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয় ব্যবসায়ী মো. সোহাগ ওরফে লাল চাঁদকে। হত্যার আগে ডেকে নিয়ে তাঁকে পিটিয়ে ও ইট-পাথরের টুকরা দিয়ে আঘাত করে মাথা, শরীরের বিভিন্ন অংশ থেঁতলে দেওয়া হয়। এক পর্যায়ে তাঁকে বিবস্ত্রও করা হয়। তাঁর শরীরের ওপর উঠে লাফায় কেউ কেউ। ওই ঘটনা জানাজানি হলে বের হয় সোহাগের কাছে চাঁদা দাবি করেছিলেন কয়েকজন। তা না দেওয়ায় তাঁর ওপর এই বর্বরতা চালানো হয়। পরে পুলিশ জানায়, এক্ষেত্রে ব্যাবসায়িক দ্বন্দ্ব ছিল। ওই ঘটনার পর রাজধানীর কোতোয়ালি থানায় গত ১০ জুলাই নিহতের বোন মঞ্জুয়ারা বেগম মামলা করেছেন।