বিশেষ সংবাদদাতা
যুক্তরাষ্ট্রে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নেতৃত্বে ঘোষিত নতুন পাল্টা শুল্কনীতির ছায়া যখন বাংলাদেশের রফতানি অর্থনীতিতে অনিশ্চয়তা ডেকে আনে, ঠিক তখনই আশাব্যঞ্জক এক সম্ভাবনা উঁকি দিচ্ছে। ৩৫ শতাংশ শুল্ক আরোপের ঘোষণার বিপরীতে, শেষ পর্যন্ত তা ১৫-২০ শতাংশে নেমে আসতে পারে বলে সূত্রমতে জানা গেছে। এটি বাস্তবায়িত হলে, অন্তর্বর্তী সরকারের জন্য এটি এক বিরাট কূটনৈতিক অর্জন হিসেবে বিবেচিত হবে।
ঘোষণা ও উদ্বেগ : শুল্কনাটকের পটভূমি : ২০২৫ সালের ৮ জুলাই, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বাংলাদেশের পণ্যের ওপর ৩৫ শতাংশ পাল্টা শুল্ক আরোপের ঘোষণা দেন, যা ১ আগস্ট থেকে কার্যকর হওয়ার কথা। এর আগে ৯ এপ্রিল যুক্তরাষ্ট্র ৬০টি দেশের জন্য একই ধরনের শুল্ক তিন মাসের জন্য স্থগিত করেছিল, তবে ওই সময়সীমা শেষ হওয়ার আগেই বাংলাদেশকে উচ্চ শুল্কের ঝুঁকিতে ফেলা হয়।
বাংলাদেশের তৈরী পোশাক, চামড়া, হস্তশিল্পসহ প্রধান রফতানি খাতগুলো এতে ব্যাপক ক্ষতির আশঙ্কায় পড়ে। পূর্বে যুক্তরাষ্ট্রে গড় শুল্কহার ছিল ১৫.৫ শতাংশ, যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২২-২৩ শতাংশে। ৩৫ শতাংশ হার কার্যকর হলে এটি হয়ে দাঁড়াত এক গভীর বাণিজ্যিক আঘাত।
প্রতিক্রিয়া : দ্রুত কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক উদ্যোগ : বাংলাদেশ সময় ২৩ জুলাই যুক্তরাষ্ট্রে পাঠানো হয় একটি বিশদ অবস্থানপত্র। এরপর ২৯ জুলাই থেকে ওয়াশিংটনে শুরু হয় তিন দিনব্যাপী উচ্চপর্যায়ের বাণিজ্য আলোচনা। বাংলাদেশ প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দেন বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন। তার সাথে ছিলেন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা খলিলুর রহমান, বাণিজ্যসচিব মাহবুবুর রহমান ও অতিরিক্ত সচিব নাজনীন কাউসার চৌধুরী। বৈঠকে ওয়াশিংটনে বাংলাদেশের দূতাবাসের শীর্ষ কূটনীতিকরাও অংশ নেন।
যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে নেতৃত্ব দেন সহকারী ট্রেড রিপ্রেজেন্টেটিভ ব্রেন্ডন লিঞ্চ। আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু ছিল পাল্টা শুল্ক হ্রাস, বাণিজ্য ভারসাম্য এবং পারস্পরিক আমদানি-বাণিজ্য সম্প্রসারণ।
আলোচনার ফলাফল : আশাবাদের ইঙ্গিত : ওয়াশিংটনে অবস্থানরত বাণিজ্যসচিব মাহবুবুর রহমান সাংবাদিকদের জানান, ‘২৯ জুলাই আমাদের বৈঠকে ইউএসটিআরের কর্মকর্তারা বাংলাদেশের ওপর শুল্ক কমানো হবে বলে ইঙ্গিত দিয়েছেন। শুল্ক উল্লেখযোগ্যভাবে কমবে বলে আশা করছি।’
তিন দিনের আলোচনার ফলাফলের ওপর ভিত্তি করে পারস্পরিক বাণিজ্য নিয়ে চুক্তির সম্ভাবনাও রয়েছে বলে মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে।
ভিয়েতনাম মডেল ও বাংলাদেশের যুক্তি : বিশ্লেষকদের মতে, বাংলাদেশের অবস্থান যুক্তরাষ্ট্রের কাছে গ্রহণযোগ্য হওয়ার অন্যতম কারণ ভিয়েতনাম উদাহরণ। ভিয়েতনামের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য ঘাটতি যেখানে ১২৩ বিলিয়ন ডলার, সেখানে তারা ২০ শতাংশ পাল্টা শুল্কে সমঝোতায় পৌঁছেছে। বাংলাদেশের ঘাটতি মাত্র ৬ বিলিয়ন ডলার, যা আগামী এক-দেড় বছরে দেড় বিলিয়ন ডলার পর্যন্ত কমিয়ে আনার প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছে।
বাণিজ্যসচিব বলেন, ‘ভিয়েতনাম যেখানে ১০ বিলিয়নের বেশি ঘাটতি কমাতে পারবে না, আমরা সে তুলনায় অনেক ভালো অবস্থানে আছি। আশা করছি, আমাদের শুল্কহার ভিয়েতনামের চেয়েও কম হবে।’
প্রতিশ্রুত আমদানি : কূটনৈতিক বিনিময়নীতি : শুল্কহ্রাসের বিনিময়ে বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্র থেকে ১.৫ বিলিয়ন ডলারের গম, ডাল এবং এলএনজি আমদানির সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এর মধ্যে বছরে সাত লাখ টন গম আমদানির জন্য জি-টু-জি ভিত্তিতে চুক্তি সম্পন্ন হয়েছে এবং আরো ২.২০ লাখ টনের প্রস্তাব অনুমোদিত।
এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্র থেকে ২৫টি বোয়িং বিমান কেনার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। বেসরকারি খাত থেকেও তুলা, সয়াবিন, গম ও ডাল আমদানির লক্ষ্যে একটি প্রতিনিধিদল যুক্তরাষ্ট্রে রয়েছে।