ডিজিটাল ডেস্ক
কিন্তু জামায়াতের সংগঠিত শক্তির বাইরে সাধারণ মানুষের বিস্তৃত বা ব্যাপক সমর্থন নেই বলে বিশ্লেষকেরা মনে করেন। অন্যদিকে, নির্বাচন ইস্যুতে সরব থাকা বিএনপির প্রতি সাধারণ মানুষের সমর্থন বিস্তৃত, ব্যাপক।
গত বছরের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর আওয়ামী লীগের অনুপস্থিতিতে বিএনপির সমর্থন আরও বেড়েছে। ফলে ভোট হলেই বিএনপি ক্ষমতায়, এ ধরনের আলোচনায় রয়েছে রাজনীতিতে।
দল ক্ষমতার দ্বারপ্রান্তে, এমন সম্ভাবনা যখন দেখা যাচ্ছে, সে সময় বিএনপির কোনো নেতা বা প্রার্থী পরাজিত হতে চাইবেন না বলে মনে করেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা।
আর এই পরিস্থিতি চাপে ফেলেছে জামায়াতকে। সেকারণে দলটি লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড বা সব দলের জন্য সমান সুযোগ তৈরি করাসহ বিভিন্ন দাবি তুলেছে।
তবে বিভিন্ন শর্ত দিয়ে আন্দোলনের হুমকি দেওয়ার পেছনে জামায়াতের সূত্রগুলো কয়েকটি কারণের কথা উল্লেখ করছে।
এর মধ্যে প্রথমত, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টার লন্ডন বৈঠক ও যৌথ বিবৃতি দেওয়ার বিষয়কে জামায়াত মেনে নিতে পারেনি। কারণ এর মাধ্যমে একটি দলের পক্ষে সরকার প্রধানের পক্ষ থেকে বার্তা দেওয়া হয়েছে বলে মনে করছে তারা।
সেই লন্ডন বৈঠকের সিদ্ধান্তের ধারাবাহিকতায় শেষপর্যন্ত ফেব্রুয়ারিতেই নির্বাচন ঘোষণা করা হয়েছে। নির্বাচনের এই সময় ঠিক করা এবং তা ঘোষণা করার ক্ষেত্রে অন্য রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করা হয়নি। এ নিয়েও ক্ষোভ রয়েছে জামায়াতের।
এছাড়া আওয়ামী লীগের শাসনের পতনের বছর-পূর্তিতে গত পাঁচই অগাস্ট ঢাকায় মানিক মিয়া অ্যাভিনিউতে সমাবেশ থেকে প্রধান উপদেষ্টা জুলাই ঘোষণাপত্র ঘোষণা করেছেন।
সেদিনই রাতে তিনি বেতার-টেলিভিশনের মাধ্যমে জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচনের ঘোষণা দিয়েছেন।
পাঁচই অগাস্টেই নির্বাচনের ঘোষণা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে জামায়াতের। দলটি মনে করে, জুলাই ঘোষণাপত্র দেওয়ার একইদিনে নির্বাচনের সময় ঘোষণার পেছনে কোনো পক্ষের চাপ থাকতে পারে।
ঘটনাগুলোর ধারাবাহিকতার উল্লেখ করে জামায়াত নেতারা বলছেন, একটি ‘ডিজাইনড’ বা সাজানো নির্বাচন করার চেষ্টা করা হচ্ছে।
এ ধরনের চিন্তার কারণ হিসেবে দলটি বেশ কিছু বিষয় ও অভিযোগ সামনে আনছে। তাদের বড় অভিযোগ হচ্ছে, তারেক রহমানের সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টার লন্ডন বৈঠকের পর থেকেই সারাদেশে প্রশাসন বিএনপির প্রতি দুর্বলতা দেখাচ্ছে। প্রশাসন বিএনপির দিকে ঝুঁকে পড়ছে। ফলে অন্য দলগুলোর জন্য লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড থাকছে না।
জামায়াত ও এনসিপি তাদের শর্ত বা দাবির ব্যাপারে বিভিন্ন যুক্তি দিচ্ছে। কিন্তু জামায়াতের অবস্থান বোঝা খুব কঠিন বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক মাহবুব উল্লাহ। তিনি বিবিসি বাংলাকে বলেন, দল দুটোর এমন অবস্থান বিএনপির ওপর চাপ তৈরির কৌশল হতে পারে। সেখানে নির্বাচনে আসনের ব্যাপারে দরকষাকষির বিষয়ও থাকতে পারে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অনেকে এ-ও বলছেন, তাদের এ ধরনের অবস্থানের কারণে নির্বাচন নিয়ে সন্দেহ, সংশয় বা অনিশ্চয়তা আরও বাড়ে পারে।
এবি পার্টির চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান মঞ্জু মনে করেন, রাজনৈতিক দলগুলোর মাঝে বিভিন্ন বিষয়ে বিভেদের কারণে আগামী নির্বাচন সংঘাতপূর্ণ হতে পারে।
তিনি এ-ও বলেন, আওয়ামী লীগ সেক্ষেত্রে সুযোগ নেবে এবং তারাও নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করার সব ধরনের চেষ্টা করবে। সেজন্য আমি মনে করি গণঅভ্যুত্থানের সকল পক্ষ ২০১৮ মডেলের একটি জোট করলে এই আশঙ্কা দূর করা সম্ভব হবে।
শর্ত বা দাবিগুলো কী
জামায়াত ও এনসিপির কমন দাবি হচ্ছে, সংবিধানসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংস্কারের প্রস্তাব নিয়ে দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন যে জুলাই সনদ তৈরি করছে, সেই সনদ বাস্তবায়নের আইনগত ভিত্তি দিতে হবে। এবং সনদ বাস্তবায়ন করে তার ভিত্তিতে নির্বাচনে যেতে হবে।
এখানে বিএনপির অবস্থান কিন্তু ভিন্ন। তারা চায়, নির্বাচন সম্পর্কিত বিষয়গুলো ছাড়া সংবিধানসহ অন্য বিষয়ে সংস্কার নির্বাচিত সংসদ করবে।
প্রধান উপদেষ্টার ঘোষিত জুলাই ঘোষণাপত্রেও সনদ বাস্তবায়নের দায়িত্ব নির্বাচিত সংসদকে দেওয়া হয়েছে।
আর এতে আপত্তি জামায়াত ও এনসিপির। তারা লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড বা নির্বাচনের আগে এখন থেকেই সব দলের জন্য সমান সুযোগ সৃষ্টির দাবি তুলেছে।
উচ্চকক্ষ ও নিম্নকক্ষ, সংসদের উভয় কক্ষে ভোটের আনুপাতিক হার বা পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচনের দাবিকে আবারও জোরালোভাবে সামনে এনেছে জামায়াত। এসব দাবিতে তাদের সঙ্গে ইসলামী আন্দোলনসহ ইসলামপন্থী বিভিন্ন দলও রয়েছে।
এই দলগুলো রাজপথে আন্দোলন কর্মসূচি দেওয়ার কথাও বলছে।
তবে বিএনপি শুরু থেকেই পিআর পদ্ধতিরও বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে। দলটির নেতারা বলছেন, জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের বৈঠকগুলোতে একটিমাত্র দল ইসলামী আন্দোলন পিআর পদ্ধতির কথা তুলেছিল। এছাড়া এটি আলোচ্যসূচিতেও ছিল না।
এখন ওই দাবি আবার সামনে আনায় এর উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন বিএনপি নেতারা।
বিভিন্ন শর্ত তুলে আন্দোলনের হুমকি দেওয়ার বিষয়কে নির্বাচন ভণ্ডুল করার কৌশল বলেও অভিযোগ করা হচ্ছে।
তবে জামায়াতে নায়েবে আমির সৈয়দ আব্দুল্লাহ মা. তাহের বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য সংস্কারের সনদ আগে বাস্তবায়ন করতে হবে। যারা এতে বাধা তৈরি করছে, তারাই নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে চায়।
এনসিপি নেতাদের বক্তব্যও একইরকম। দলটির সদস্য সচিব আখতার হোসেন বিবিসি বাংলাকে বলেন, নতুন সংবিধান, সংস্কার ও বিচারের বিষয়ে পাশ কাটিয়ে সরকার এখন নির্বাচনকে একমাত্র অগ্রাধিকার হিসেবে নিয়েছে। সেজন্য সমস্যা তৈরি হচ্ছে।
জামায়াত ও এনসিপি কতদূর যেতে পারে
দল দুটির নেতারা তাদের দল ও দলের বাইরে বিভিন্ন ফোরামে বক্তব্য-বিবৃতিতে তাদের দাবিগুলোকে তুলে ধরছেন। জামায়াত, এনসিপির সূত্রগুলো বলছে, তারা রাজপথে সমাবেশ, বিক্ষোভ মিছিলের কর্মসূচি নিতে পারে।
নির্বাচনের আগে সংস্কার সনদের বাস্তবায়নসহ তাদের দাবিগুলো পূরণ না হলে ভোট বর্জনের মতো অবস্থান নেওয়ার চিন্তাও ওই দলগুলোর ভেতরে রয়েছে বলে জানা গেছে।
বিএনপি চাপে পড়তে পারে?
জামায়াত, এনসিপি নির্বাচন বর্জন করলে সেই ভোটে প্রতিদ্বন্দ্বিতা থাকবে না। এতে নির্বাচন প্রশ্নবদ্ধি হবে এবং তা বিএনপিকে বেকায়দায় ফেলবে বলে বিশ্লেষকেরা মনে করেন।
তারা বলছেন, রাজনৈতিক কার্যক্রম নিষিদ্ধ হওয়া আওয়ামী লীগের অনুপস্থিতিতে নির্বাচনে বিএনপি খুশি। কিন্তু তাতে নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক বা অন্তর্ভুক্তিমূলক হবে না, সেই অভিযোগ থাকবে।
এছাড়া নির্বাচনী দৌড়ে এখনকার প্রভাবশালী দলগুলোও যদি না থাকে, সেটা বিএনপির জন্য চাপ বাড়াবে।
তবে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ও দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ, তারা দুজনই বিবিসি বাংলার সঙ্গে আলাপে নির্বাচন ঘিরে জামায়াত ও এনসিপি নেতাদের বক্তব্যকে মাঠের বক্তৃতা বলে উল্লেখ করছেন।
সালাহউদ্দিন আহমদ বলছেন, দলগুলোর তাদের স্ব স্ব অবস্থানের পক্ষে চাপ তৈরির বা দাবি আদায়ের চেষ্টা থাকবে। কিন্তু সব দলই ফেব্রুয়ারিতেই নির্বাচনে অংশ নেবে।
সরকার কী করতে পারে?
যদিও জামায়াত ও এনসিপি নেতারা বলছেন, নির্বাচন নিয়ে অনিশ্চয়তা কাটাতে সরকারের পক্ষ থেকে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করা উচিত।
কিন্তু মনে হয় না-সরকার এখনই আবার আলোচনার পথে হাঁটবে। অন্তর্বর্তী সরকারের একজন উপদেষ্টা বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, নির্বাচনের সময় ঘোষণার পর এখন নির্বাচন কমিশন রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করবে।
নির্বাচন কমিশন অবশ্য এরইমধ্যে বলেছে যে, তারা দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করবে। সেখানে নির্বাচনের তফসিল ও পরিবেশ নিয়ে আলোচনা হতে পারে। কিন্তু সংবিধান সংস্কার বা এর বাস্তবায়নের দাবি-দফা নিয়ে আলোচনা করার ফোরাম সেটি নয়।
অন্যদিকে, বিশ্লেষকদের পাশাপাশি রাজনীতিকদেরও অনেকে বলছেন, ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন করার ব্যাপারে সরকারের ভেতরেই একটি পক্ষের জোরালো আপত্তি ছিল। সেটিও নির্বাচন নিয়ে সন্দেহ, সংশয়ের পেছনে অন্যতম একটি কারণ।
পরিস্থিতিটা কি নির্বাচনের জন্য হুমকি
নির্বাচনের আগে কোনো দল যদি দাবিদফা নিয়ে রাজপথে কর্মসূচি দেয়, সেটা পরিস্থিতিকে অস্থিতিশীল করতে পারে বলে বিশ্লেষকেরা মনে করেন।
জামায়াত ও এনসিপি যদিও বলছে, ফেব্রুয়ারিতেই নির্বাচনে তাদের আপত্তি নেই। কিন্তু নির্বাচনের আগে সংস্কারের জুলাই সনদ বাস্তবায়নের দাবি থেকে তারা সরবেন না।
অন্যদিকে, বিএনপিও তাদের অবস্থানে কোনো ছাড় দেবে না। ফলে নির্বাচন নিয়ে অনিশ্চয়তা আরও বাড়তে পারে বলে বিশ্লেষকদের অনেকে আশঙ্কা প্রকাশ করছেন।
তারা বলছেন, এখন গণতন্ত্রে ফিরতে ভোটের প্রয়োজন। কিন্তু কোনো পক্ষের বা কোনো দলের কারণে নির্বাচন অনিশ্চিত হয়ে পড়লে এর দায় তাদের ওপরই বর্তাবে। ফলে কোনো রাজনৈতিক দল সেই দায় নিতে চাইবে না।