নিজস্ব প্রতিবেদক
বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে হঠাৎ উত্থান নতুন কিছু নয়। তবে জান্নাত আরা হেনরীর গল্প যেন এক রহস্যময় উপাখ্যান। এক সময়ের সাধারণ সহকারি শিক্ষিকা, আজ তিনি আলোচিত সংসদ সদস্য। তার এই উত্থান নিছক রাজনৈতিক সাফল্য নয়; বরং এর ভেতর লুকিয়ে আছে অদৃশ্য ক্ষমতার খেলা ও সীমাহীন সম্পদের বিস্তার। যেন তার হাতে সত্যিই ছিল কোনো অদৃশ্য আলাদিনের চেরাগ, যা ঘষলেই বেরিয়ে আসত কোটি কোটি টাকা, বিলাসবহুল গাড়ি আর বৈদেশিক মুদ্রার অগাধ ভাণ্ডার।বাংলাদেশি ফ্যাশন ট্রেন্ড
সংসদ সদস্য হিসেবে বৈধ আয়ের সীমা যতটুকু, হেনরীর জীবনযাত্রার সঙ্গে তার কোনো সামঞ্জস্য নেই। ব্যক্তিগত ব্যবহারের জন্য তার নামে রয়েছে অন্তত ১৬টি বিলাসবহুল গাড়ি। এগুলো কেবল চলাচলের বাহন নয়, বরং কোটি টাকার দামে কেনা নামিদামি ব্র্যান্ড, যা সাধারণ এমপি ভাতা বা শিক্ষিকার পুরোনো বেতনের সঙ্গে কোনোভাবেই মেলে না। প্রশ্ন উঠছে—এই বিপুল অর্থের উৎস কোথায়?
এর বাইরেও আরও ভয়াবহ চিত্র উঠে এসেছে ব্যাংক লেনদেনে। অনুসন্ধানে জানা গেছে, তার নামে ও নিয়ন্ত্রণে থাকা ৩৫টি ব্যাংক অ্যাকাউন্টে বিগত কয়েক বছরে লেনদেন হয়েছে প্রায় ২,০০০ কোটি টাকা। এ অঙ্ক কোনো সাধারণ সংসদ সদস্যের সামর্থ্যের বহির্ভূত। আরেকটি তথ্য আরও আলোড়ন তুলেছে—বিদেশি ব্যাংক হিসাব ও বিনিয়োগ থেকে পাওয়া গেছে ১৩ কোটি ৭৮ লাখ মার্কিন ডলার। যা বাংলাদেশি মুদ্রায় কয়েক হাজার কোটি টাকার সমান।বাংলাদেশি ফ্যাশন ট্রেন্ড
অদৃশ্য এক শক্তির কারণে আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃত্বও তার কব্জায় ছিল বলে অভিযোগ রয়েছে। দলীয় ভেতরে অনেকে নীরব থাকলেও আড়ালে অনেকে স্বীকার করেন, তিনি এমন কিছু প্রভাবের অধিকারী ছিলেন, যার কারণে তাকে অগ্রাহ্য করার সাহস কারো হয়নি। তার সুপারিশে নেওয়া হয়েছে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তও। এতে স্পষ্ট হয়, হেনরীর কাছে কেবল অর্থই নয়, রাজনৈতিক প্রভাবেরও আলাদা এক অদৃশ্য শক্তি ছিল।
এই বাস্তবতায় সাধারণ মানুষের ক্ষোভ তীব্র আকার নিয়েছে। ভোটাররা বলছেন, তারা ভোট দিয়েছেন দেশের কল্যাণের জন্য, কিন্তু তাদের প্রতিনিধি নিজের ভাগ্য গড়তেই ব্যস্ত থেকেছেন। এক ক্ষুব্ধ কৃষক জানালেন, “আমরা দিনরাত খেটে খাই, সন্তানকে স্কুলে দিতে কষ্ট হয়, অথচ তারা ব্যাংকে হাজার কোটি টাকা রাখে, বিদেশে ডলার জমায়। এ কেমন গণতন্ত্র?”
অর্থনীতিবিদদের বিশ্লেষণ অনুযায়ী, হেনরীর অস্বাভাবিক সম্পদ বৃদ্ধির ব্যাখ্যা কোনোভাবেই বৈধ আয়ের সঙ্গে মেলে না। স্বচ্ছতার সঙ্গে বৈধ ব্যবসা থাকলে তা প্রকাশ করা যেত। গোপন লেনদেন ও বিদেশে অর্থপাচার একটিই প্রমাণ করে—এটি দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহারের ফসল। রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরাও মনে করছেন, হেনরীর কাহিনি কেবল একজন ব্যক্তির নয়; বরং গোটা রাজনৈতিক সংস্কৃতির প্রতিফলন। গত পনেরো বছর ধরে ক্ষমতায় থেকে আওয়ামী লীগ উন্নয়ন ও মেগা প্রকল্পের গল্প বললেও দুর্নীতি, প্রভাব খাটানো ও রাতারাতি সম্পদশালী হওয়ার অভিযোগ ছাপিয়ে গেছে। হেনরির আলাদিনের চেরাগ যেন সেই দীর্ঘ শাসনের প্রতীক—যা দেখায় কীভাবে সাধারণ একজন মানুষ ক্ষমতার আসনে বসে অগাধ সম্পদের মালিক হয়ে উঠতে পারে।
প্রশ্ন এখন একটাই—রাষ্ট্র কি সেই আলাদিনের চেরাগ কেড়ে নেওয়ার শক্তি রাখে? নাকি অদৃশ্য শক্তির পাহারায় এই সাম্রাজ্য আরও বিস্তৃত হবে? জনগণের মনে সংশয় গভীর হচ্ছে। জবাবদিহি প্রতিষ্ঠা ছাড়া কোনো দিন কি ভাঙবে এই চেরাগের জাদু? আজ তাই জান্নাত আরা হেনরীর গল্প কেবল একটি নামের কাহিনি নয়; এটি বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির অন্ধকার প্রতিচ্ছবি। আলাদিনের চেরাগ যেভাবে তাকে রাতারাতি ধনী করেছে, সেই চেরাগের আলোয় যদি রাজনীতির মাঠ আলোকিত হয়, তবে দেশের ভবিষ্যৎ অচিরেই অন্ধকারে ঢেকে যাবে। জনগণ তাই আজ একটাই দাবি তুলছে—এ চেরাগ ভাঙুক, জবাবদিহি আসুক, ন্যায় ফিরে আসুক রাষ্ট্রের প্রতিটি স্তরে।