নিজস্ব প্রতিবেদক
দেশের ব্যাংক খাতে কয়েক বছর ধরেই অস্থিরতা বিরাজ করছে। গ্রাহকের আমানত ফেরত দিতে ব্যর্থ হওয়া এবং আওয়ামী লীগ আমলে হওয়া অনিয়ম-দুর্নীতি ও অর্থ লুটপাটের ঘটনায় ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের প্রতি মানুষের আস্থা অনেক কমেছে।
দেশের ব্যাংক খাতে কয়েক বছর ধরেই অস্থিরতা বিরাজ করছে। গ্রাহকের আমানত ফেরত দিতে ব্যর্থ হওয়া এবং আওয়ামী লীগ আমলে হওয়া অনিয়ম-দুর্নীতি ও অর্থ লুটপাটের ঘটনায় ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের প্রতি মানুষের আস্থা অনেক কমেছে। চলমান এ অস্থিরতা ও আস্থাহীনতার সুযোগ নিচ্ছে মাল্টিলেভেল মার্কেটিং (এমএলএম) কোম্পানি ও সমবায় সমিতিগুলো। স্বল্প আয়ের সাধারণ মানুষকে টার্গেট করে প্রথমে বিশ্বাস অর্জন, তারপর লাভের আশা দেখিয়ে টাকা হাতিয়ে নেয়া। সম্প্রতি পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) অনুসন্ধানে দেখা গেছে, কেবল জামালপুরের মাদারগঞ্জ উপজেলায়ই গত এক বছরে ২৩টি সমবায় সমিতি হাজার কোটি টাকার বেশি অর্থ আত্মসাৎ করেছে। সারা দেশে এর পরিমাণ আরো বহুগুণ বেশি হতে পারে বলে আশঙ্কা খাতসংশ্লিষ্টদের।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, অনেকেই মূলধারার ব্যাংক থেকে টাকা তুলে উচ্চ মুনাফার প্রলোভনে বিকল্প খাতে বিনিয়োগ করছেন। বিশেষ করে নিবন্ধিত ও অনিবন্ধিত সমবায় সমিতি এবং বিভিন্ন ছদ্মবেশী এমএলএম কোম্পানি এ সুযোগে গ্রাহকদের কাছ থেকে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। প্রথমদিকে অল্প অল্প করে মুনাফা ফেরত দিলেও নির্দিষ্ট সময় পর অনেক প্রতিষ্ঠান কার্যক্রম গুটিয়ে গ্রাহকের টাকা আত্মসাৎ করছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের দুর্বলতা যত বাড়ছে, ততই সুযোগ নিচ্ছে প্রতারকরা। কার্যকর নিয়ন্ত্রণ ও নজরদারি না থাকলে এসব প্রতারণার শিকার হয়ে আরো বিপুলসংখ্যক মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
সিআইডির হিসাব অনুযায়ী, চলতি বছরের জুলাইয়ে মাদারগঞ্জ আল আকাবা বহুমুখী সমবায় সমিতি লিমিটেড নামে একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান গ্রাহকের টাকা না দিয়েই তাদের কার্যক্রম গুটিয়ে নেয়। বিষয়টি নজরে আসার পর হাজার হাজার বিনিয়োগকারী নিজেদের গচ্ছিত অর্থ ফেরত পেতে বিক্ষোভ সমাবেশ করেন। এরপর একে একে আরো ২২টি সমবায় সমিতির নাম সামনে আসে, যারা গ্রাহকের টাকা নিয়ে পালিয়েছে। এসব সমিতিতে বিনিয়োগ করেছিলেন ৫০ হাজারের বেশি গ্রাহক। আল আকাবা ছাড়াও এসব সমবায় সমিতির মধ্যে রয়েছে স্বদেশ, শতদল, নবদ্বীপ, আশার আলো, জনকল্যাণ, পরশমণি, দারিদ্র্য বিমোচন, হলি টার্গেট, স্বপ্নতরী, মাদারগঞ্জ সেবা সঞ্চয় ও ঋণদান সমবায় সমিতি লিমিটেড।
এর বাইরে আরো রয়েছে আল আকছা, রূপসী বাংলা, শ্যামল বাংলা, মাতৃভূমি, মিতালী, স্বাধীন বাংলা, অগ্রগামী, রংধনু ব্যবসায়ী সমবায় সমিতি, আল আমানত, দরিদ্র শ্রমজীবী সমবায় সমিতি, আল ইনসাফ ও জনতা শ্রমজীবী সমবায় সমিতি লিমিটেড। এসব প্রতিষ্ঠানের সদস্যদের অধিকাংশই সীমিত আয়ের কর্মজীবী। অধিক মুনাফার চটকদার বিজ্ঞাপনে আকৃষ্ট হয়েই মূলত আজ তারা একপ্রকার নিঃস্ব। গচ্ছিত অর্থ ফেরত পেতে ঘুরছেন দ্বারে দ্বারে।
দেশের প্রচলিত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর অস্থিতিশীলতার সুযোগে একশ্রেণীর লোক সমবায় সমিতি গড়ে গ্রাহকের অর্থ আত্মসাৎ করে আসছেন বলে মনে করেন সিআইডির মুখপাত্র বিশেষ পুলিশ সুপার জসীম উদ্দিন খান। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘আমাদের কাছে এ ধরনের বেশকিছু সুনির্দিষ্ট অভিযোগ রয়েছে। এগুলো অনুসন্ধান করে দেখা হচ্ছে। এরই মধ্যে আল আকাবার ৪০০ কোটি টাকার সম্পদ জব্দ করা হয়েছে। এমন আরো যেসব সমবায় সমিতি রয়েছে তাদের কার্যক্রমও অনুসন্ধান করে দেখা হচ্ছে। তাদের সার্বিক কার্যক্রমের মধ্যে অপরাধ উপাদন থাকলে আইনি ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে।’
তদন্তসংশ্লিষ্টরা বলছেন, রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতায় জামালপুরের সমবায় সমিতির ব্যাপক বিস্তার লাভ করে গত দেড় দশকে। প্রভাবশালী বিভিন্ন নেতার ছত্রছায়ায় গড়ে তোলা হয় এসব প্রতিষ্ঠান। তাদের প্রধান লক্ষ্য ছিল দরিদ্র জনগোষ্ঠী। দারিদ্র্য এবং ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের অস্থিরতার সুযোগকে কাজে লাগিয়ে এসব সমবায় সমিতি গ্রাহকের হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছে। আত্মসাতের অর্থে তারা দেশ-বিদেশে বিপুল সম্পদ তৈরি করেছে। কেউ কেউ আবার গড়ে তুলেছে বিভিন্ন ধরনের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান। গ্রাহকের আত্মসাতের অর্থে গড়ে তোলা এসব সম্পদের তালিকা করা হচ্ছে। তালিকা ধরে যাচাই-বাছাই শেষে এসব অবৈধ সম্পদ জব্দের প্রক্রিয়া শুরু করা হবে। আল আকাবা গ্রাহকের ৭০০ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছে। তাদের ৪০০ কোটি টাকার সম্পদ জব্দ করা হয়েছে। দেশে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর পরই এসব সমবায় সমিতি গ্রাহকের গচ্ছিত অর্থ ফেরত না দিয়েই নিজেদের কার্যক্রম গুটিয়ে নিয়েছে। এর মধ্যে কয়েকটি সমবায় সমিতির কর্তাব্যক্তিরাও আত্মগোপনে চলে গেছেন।
জামালপুরের সমবায় সমিতিগুলোর অর্থ আত্মসাতের অপরাধ অনুসন্ধান করছেন সিআইডির ফাইন্যান্সিয়াল ক্রাইম ইউনিটের পরিদর্শক সায়েদুল। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘দরিদ্র ও শ্রমজীবীদের টার্গেট করেই এ ধরনের সমবায় সমিতি নিজেদের কার্যক্রম শুরু করে। প্রথমদিকে তারা কিছু ক্ষুদ্র ঋণও দেয়। পরবর্তী সময়ে সুবিধামতো সময়ে উচ্চ মুনাফার প্রলোভন দেখিয়ে টাকা জামানত রাখতে উৎসাহিত করে। তারা জামানতের স্কিমগুলো এমনভাবে সাজায় যাতে গ্রাহক দীর্ঘমেয়াদের জন্য অর্থ গচ্ছিত রাখেন। এরপর একটা পর্যায়ে অর্থ ফেরত দেয়ার সময় হয়ে এলেই তারা নিজেদের কার্যক্রম গুটিয়ে নেয়। গত এক বছরে শুধু জামালপুরের একটি উপজেলায়ই ২৩টি সমবায় সমিতি গ্রাহকের অর্থ আত্মসাৎ করে নিজেদের কার্যক্রম গুটিয়ে নিয়েছে।’
কেবল সমবায় সমিতিই নয়, নতুন নতুন নামে ও রূপে এমএলএম ব্যবসার মাধ্যমেও অস্বাভাবিক মুনাফার প্রলোভন দেখিয়ে টাকা হাতিয়ে নেয়া হচ্ছে। কখনো ক্ষুদ্র ঋণ, কখনো কো-অপারেটিভ সোসাইটি বা কো-অপারেটিভ ব্যাংক, আবার কখনো মাল্টিপারপাস সোসাইটি নানা নামে শুরু হয় তাদের আর্থিক প্রতারণা। কখনো আবার চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে নতুন ধারার এমএলএম ব্যবসার ফাঁদ পাতে অনেক প্রতারক। বেকার যুবকদের সংক্ষিপ্ত প্রশিক্ষণের পর আকর্ষণীয় বেতনের চাকরি দেয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়। এজন্য জামানত হিসেবে নেয়া হয় নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা। প্রলোভন দেখানো হয় নতুন সদস্য সংগ্রহ করলে দেয়া হবে বাড়তি কমিশন।
দেশের জনগণকে এমএলএম ব্যবসা থেকে সতর্ক থাকার আহ্বান জানিয়ে গত মার্চে সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে বাংলাদেশ ব্যাংক। তাতে বলা হয়, দেশে কতিপয় প্রতিষ্ঠান বিধিবহির্ভূতভাবে গ্রাহকের আমানত বা বিনিয়োগ সংগ্রহ, রেফারেলের ভিত্তিতে কমিশন প্রদান এবং অস্বাভাবিক ও অযৌক্তিক হারে উচ্চ মুনাফা প্রদানের নামে প্রতারণার ঘটনা ঘটিয়েছে। এছাড়া অস্বাভাবিক মূল্যছাড় বা ডিসকাউন্টে বিভিন্ন ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের পণ্য বিক্রির নামেও জনগণের সঙ্গে প্রতারণা করার নজির রয়েছে। অস্বাভাবিক ও অযৌক্তিক হারে উচ্চ মুনাফা প্রদান এবং রেফারেলের ভিত্তিতে কমিশন দেয়া মাল্টিলেভেল মার্কেটিংয়ের অন্যতম বৈশিষ্ট্য, যা অতীব ঝুঁকিপূর্ণ ও গ্রাহকের বিনিয়োগ হারানোর নজির তৈরি করেছে। এ রকম প্রতারণামূলক ব্যবসায় লাভ থেকে মুনাফা না দিয়ে একদল গ্রাহকের বিনিয়োগের অর্থ থেকে আরেক দল গ্রাহককে তথাকথিত মুনাফা প্রদান করা হয়। সাম্প্রতিক সময়েও একই ধরনের প্রতারণামূলক কর্মকাণ্ড পরিলক্ষিত হওয়ায় তা বর্তমানে অনুসন্ধানের আওতায় আনা হয়েছে। এমতাবস্থায় গ্রাহকের স্বার্থ সুরক্ষা বিবেচনায় দেশের জনসাধারণকে এ ধরনের প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে লেনদেন করার ক্ষেত্রে নিরুৎসাহিত ও বিশেষভাবে সতর্কতা অবলম্বনের পরামর্শ দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
অপরাধ বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, বিগত সরকারের ব্যর্থতায় ব্যাংক খাতে বেড়েছে অস্থিতিশীলতা। সেই সঙ্গে বেড়েছে অনাদায়ী ঋণ ও খেলাপি ঋণের পরিমাণ। এছাড়া দেশের প্রায় সব ব্যাংকেরই মূলধন কাঠামো দুর্বল হয়ে পড়েছে। নতুন করে কোনো বিদেশী ব্যাংকও দেশে আসেনি। আশির দশকে যেসব বিদেশী ব্যাংক দেশে কার্যক্রম পরিচালনা করত তারাও নিজেদের গুটিয়ে নিয়ে গেছে। এ সুযোগে গ্রাহকের অর্থ হাতিয়ে নিতে উচ্চ মুনাফার প্রস্তাব দেয় সমবায় সমিতিগুলো। দেশের প্রচলিত আর্থিক খাতে অস্থিরতা তৈরি হলে এমন সমবায় সমিতির বিস্তার বাড়তে থাকে। তাদের নিবন্ধন প্রক্রিয়া থেকে শুরু করে সার্বিক বিষয়ে নজরদারি বৃদ্ধির পাশাপাশি কঠোর পদক্ষেপের দৃষ্টান্ত স্থাপনের মাধ্যমে এ ধরনের অপরাধ রোধ করতে হবে। পাশাপাশি দেশের ব্যাংকসহ প্রচলিত সব আর্থিক প্রতিষ্ঠানের অস্থিতিশীলতা দূর করতে হবে। ফেরাতে হবে সাধারণ জনগণের আস্থাও।
সমবায়ের মাধ্যমে গ্রাহকের অর্থ আত্মসাতের ঘটনাগুলো সমাজে এক ধরনের অবিশ্বাস তৈরি করে বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক এবং সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক। এ বিষয়ে তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, ‘আমাদের দেশে বড় একটা জনগোষ্ঠী আছে যারা নিজেদের অর্থ জামানত রেখে সেখান থেকে মুনাফা গ্রহণের মাধ্যমে ভবিষ্যতের সঞ্চয় গড়ে তোলার চেষ্টা করেন। মূলত তাদের টার্গেট করেই সমবায় সমিতিগুলোও উচ্চ মুনাফার চটকদার প্রলোভন দিয়ে জামানত নেয়। বিশ্বাস তৈরির জন্য প্রথম কিছুদিন তারা মুনাফা দেয়। এতে গ্রাহক নিকটাত্মীয় ও পরিচিতজনদের মাঝে প্রচারণা চালিয়ে আরো জামানত সংগ্রহের চেষ্টা করেন। এর মধ্যে সমবায় সমিতিগুলোর যখন কাঙ্ক্ষিত অর্থ সংগ্রহ হয়ে যায়, তখন প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম গুটিয়ে নিয়ে পালায়। এতে একধরনের সামাজিক অবিশ্বাস তৈরি হয়। সেই অবিশ্বাসের প্রভাব পড়ে দেশের প্রচলিত আর্থিক খাতসহ অন্যান্য খাতেও। এ ধরনের অপরাধ নিয়ন্ত্রণ করতে হলে সবার আগে প্রয়োজন আইনের দৃষ্টান্তমূলক প্রয়োগ। কিন্তু সেখানে নানা দীর্ঘসূত্রতা রয়েছে। বিশেষ করে দেখা যায় কেউ অর্থ আত্মসাৎ করে দেশ ছেড়ে যাওয়ার পর তার দেশ ত্যাগে নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়। এ ধরনের ঘটনাগুলো আর্থিক অপরাধকে আরো বেশি উৎসাহিত করে।’