নিজস্ব প্রতিবেদক
চাকরির বয়স ২৫ বছর পেরোলেই বাধ্যতামূলক অবসর। শাস্তি এর কম হলে সাময়িক বরখাস্ত। আবার পছন্দের কেউ হলে গ্রাম থেকে শহরে বদলি। অপছন্দের তালিকায় পড়লে প্রত্যন্ত এলাকায় বদলি।
এ ছাড়া রয়েছে বিভিন্ন অভিযোগে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) জেরা। ৬৯০ জন কর্মকর্তার ধাপে ধাপে হয়েছে এমন অভিজ্ঞতা। অধ্যাদেশ জারি করে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) ভেঙে দেওয়ার প্রতিবাদে আন্দোলন থেমে গেলেও থেমে নেই শাস্তির খড়্গ। তাই উদ্বেগে সময় কাটছে এনবিআর কর্মকর্তাদের।
এর সরাসরি বিরূপ প্রভাব পড়ছে রাজস্ব আদায়েও। বিদায়ি অর্থবছরে ৯২ হাজার কোটি টাকার বড় রাজস্ব ঘাটতির পর চলতি বছরের প্রথম মাসেও ঘাটতি তিন হাজার কোটি টাকা।
জানা গেছে, এখন পর্যন্ত আন্দোলনে যুক্ত থাকার অভিযোগে আয়কর ও কাস্টমস ক্যাডারের চার শীর্ষ কর্মকর্তাকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়েছে। বিভিন্ন পর্যায়ের ৩৬ কর্মকর্তাকে করা হয়েছে সাময়িক বরখাস্ত।
দুই ক্যাডারের ৬৩৩ জন কর্মকর্তাকে সারা দেশের নানা প্রান্তে শাস্তিমূলক বদলি করা হয়েছে। আয়কর ক্যাডারের ৩৭৫ জন এবং কাস্টমস ক্যাডারের ২৫৯ জন কর্মকর্তাকে বদলি করা হয়েছে। এ ছাড়া এনবিআরের দুই সদস্যসহ ১৬ জন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে দুদকে অভিযোগ আনা হয়েছে।
এখন শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তা যাঁদের চাকরির বয়স ২৫ বছর পার হয়েছে, তাঁরা আছেন বাধ্যতামূলক অবসর আতঙ্কে। অন্য কর্মকর্তাদের মধ্যে রয়েছে সাময়িক বরখাস্ত, বদলি ও দুদকে হয়রানির ভয়।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে দুই ক্যাডারের অনেক কর্মকর্তা বলছেন, ‘ব্যবসায়ীদের মধ্যস্থতা ও সরকারের আশ্বাসে এনবিআরের আন্দোলন থেমে গিয়েছিল। তখন প্রতিহিংসামূলক আচরণ না করার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল। তবে বাস্তবতা এর উল্টোটি। এখন কমবেশি প্রতিদিনই সাময়িক বরখাস্ত ও বদলি করা হচ্ছে।’
রাজস্ব আদায়কারী এই প্রতিষ্ঠানের সদর দপ্তর ও বিভিন্ন কার্যালয়ে কর্মকর্তাদের কাজে ধীরগতি লক্ষ করা গেছে। কাজ করলেও নেই স্বতঃফূর্ত মনোভাব। প্রতিটি মুহূর্তে তাঁরা করছেন চাকরি হারানোর ভয়। এর প্রভাব পড়েছে গত অর্থবছরের শেষ সময় ও চলতি অর্থবছরের প্রথম মাসে। ২০২৫-২৬ অর্থবছরের জুলাইয়ে দুই হাজার ৮৬২ কোটি টাকা রাজস্ব ঘাটতি হয়েছে। এ সময় আদায় হয়েছে ২৭ হাজার ২৪৯ কোটি টাকা। লক্ষ্য ছিল ৩০ হাজার ১১১ কোটি টাকা।
অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীরা মনে করেন, কর্মকর্তাদের মধ্যে এমন অবস্থা চলতে থাকলে রাজস্ব আদায়ে বড় ধরনের বিরূপ প্রভাব পড়তে পারে। সরকারের উচিত এনবিআর কর্মকর্তাদের আস্থা ফিরিয়ে আনা।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘শঙ্কা থাকলে এনবিআর কর্মকর্তারা মনস্তাত্ত্বিক চাপে পড়বেন। মানসিক অবস্থা দুর্বল থাকলে রাজস্ব আদায়ে অবশ্যই প্রভাব পড়বে। এখন সরকারকে সুনির্দিষ্টভাবে জানাতে হবে—যাঁরা কোনো অনিয়ম করেননি, তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে না। আবার যাঁরা দুর্নীতি-অনিয়ম করেছেন, তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। যাঁদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ নেই, তাঁরা যেন হয়রানির শিকার না হন, এ বিষয়টিও খেয়াল রাখতে হবে।’
বিকেএমইএর নির্বাহী সভাপতি ফজলে শামীম এহসান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘এনবিআরে আন্দোলন থেমে যাওয়ার পর সরকার কথা রাখেনি। সমাধানটা একটু নরমভাবে করা প্রয়োজন ছিল। বারবার বলার চেষ্টা করেছি, এনবিআর কর্মকর্তাদের আস্থায় আনতে হবে। আস্থা ও বিশ্বাসের জায়গাটা না থাকলে রাজস্ব আদায়ে সমস্যা তো হতেই পারে। তাঁদের খুব মনোযোগ দিয়ে কাজ করতে হয়। আমরা চাই, সবকিছু শেষ করে দিয়ে তাঁদের মানসিক স্বস্তির জায়গাটা ঠিক করা; যাতে তাঁরা কাজ করতে পারেন।’
গত ২২ জুন আন্দোলনে অংশ নেওয়ার কারণে পাঁচজন উপকর কমিশনারকে বদলির আদেশ দেয় এনবিআর। দক্ষ এই কর্মকর্তাদের কোনো কারণ ছাড়াই বদলি করায় ক্ষোভে ফুঁসে ওঠেন অন্য কর্মকর্তারা। পরে অনেকে বদলির আদেশ ছিঁড়ে এর প্রতিবাদ জানান। পরবর্তী সময়ে এই অভিযোগে ২৭ জনকে সাময়িক বরখাস্ত করে এনবিআর। তবে সে সময় বিভিন্ন ভিডিও ও সংবাদের ফুটেজ বিশ্লেষণে দেখা গেছে, কয়েকজন এই বদলির আদেশ না ছিঁড়েও বরখাস্ত হয়েছেন। আন্দোলন চলাকালে দাপ্তরিক কাজে বাধা দেওয়ার কারণ দেখিয়ে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে ৯ কর্মকর্তাকে। তাঁদের মধ্যে একজন যুগ্ম কমিশনার সে সময়ে লিয়েনে ছিলেন। কয়েকজনের দাবি, আন্দোলনে যাঁরা অংশ নিয়েছেন, তাঁরা স্বেচ্ছায় নিয়েছেন। এর সঙ্গে দাপ্তরিক কাজে বাধা দেওয়ার সম্পর্ক নেই।
এরপর বিভিন্ন সময়ে আরো ৬০০ কর্মকর্তাকে বদলি করা হয়েছে। এর মধ্যে ১০ জুলাই একযোগে ৪২ জন যুগ্ম কর কমিশনার, ১৫ জুলাই ১১ জন কাস্টমস কমিশনার, ৩১ জুলাই ২৪ জন যুগ্ম কমিশনার ও ২৫ জন অতিরিক্ত কমিশনার, ১২ আগস্ট ৮৭ জন সহকারী কমিশনার ও ৭৩ জন উপকমিশনার, ১৩ আগস্ট ১৯ জন কর কমিশনার ও ১০ জন কাস্টমস কমিশনার, ১৪ আগস্ট ৮৪ জন উপকর কমিশনার ও দুই কাস্টমস কমিশনার, ১৮ আগস্ট ১২৯ জন সহকারী কর কমিশনার, ১৯ আগস্ট ৪১ জন অতিরিক্ত কর কমিশনার, ২০ আগস্ট ৫৩ জন সহকারী কর কমিশনারকে বদলি করা হয়।
আগস্টের শুরুর দিকে গ্রেড-৩ থেকে গ্রেড-২ পদে পদোন্নতি পান একজন সদস্য। তদবির করে এবং আন্দোলনের বিপক্ষের শক্তি প্রমাণ করে অনেকে বাগিয়ে নিয়েছেন গুরুত্বপূর্ণ পদ ও বদলি।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এনবিআরের কর্মকর্তারা বলছেন, নিজেদের পক্ষের মনে করা হলে ভালো ও গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় বসানো হচ্ছে। বিপক্ষের মনে করা হলেই পাঠানো হচ্ছে ঢাকার বাইরে। বন্ধ হয়ে যাওয়া প্রকল্পেও বদলি করা হচ্ছে। অনিয়মের দায়ে শাস্তি পাওয়া কর্মকর্তারাও পাচ্ছেন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব। যোগ্য ব্যক্তিরা মূল্যায়িত না হওয়ার এই চর্চার অবসান চান তাঁরা।
আন্দোলন-পরবর্তী সময়ে এনবিআর কর্মকর্তাদের মধ্যে এক ধরনের আতঙ্ক দেখা যাচ্ছে। এ সমস্যা সমাধানের বিষয়ে জানতে চাইলে সংস্থাটির চেয়ারম্যান মো. আবদুর রহমান খান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আতঙ্কে থাকার কোনো কারণ নেই। কাল সকালবেলায়ও আমি ৬৫০ জন কর্মকর্তার সঙ্গে বৈঠক করেছি। সেখানে আমি আতঙ্কগ্রস্ত না হতে বলেছি। কেউ আতঙ্ক ছড়ালে আমাকে ব্যক্তিগতভাবে মেসেজ দিতে বলেছি। কোনো তালিকা করা হচ্ছে না, কিছু হবে না।’
এতে আতঙ্ক কাটবে কি না, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এটা তো তাঁদের ব্যাপার। আমি তো কোনো আতঙ্ক ছড়াচ্ছি না। আমি চাই, সবাই তাঁদের সক্ষমতা অনুযায়ী পুরোপুরি সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করবেন।’
এরপর গতকাল বুধবারও আয়কর বিভাগের ২২৫ জন কর পরিদর্শককে একযোগে বদলি করা হয়েছে। এনবিআরের কর প্রশাসন-২ শাখার দ্বিতীয় সচিব মো. আনিসুল ইসলাম স্বাক্ষরিত প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, জনস্বার্থে জারি করা এ আদেশ অবিলম্বে কার্যকর হবে।