বিশেষ সংবাদদাতা
বাংলাদেশে প্রতিদিনই রক্তাক্ত হচ্ছে সড়ক। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাবে বছরে গড়ে ২০-২৫ হাজার মানুষ প্রাণ হারান এবং কয়েকগুণ বেশি মানুষ আহত হন। কঠোর আইন থাকলেও প্রয়োগে শিথিলতা, রাজনৈতিক প্রভাব, চালক-যাত্রী-মালিকদের দ্বন্দ্ব এবং অবকাঠামোগত ঘাটতি—সব মিলেই সড়ক শৃঙ্খলা আজ জাতীয় সংকটে পরিণত হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শুধু আইন প্রণয়ন নয়, বরং বাস্তবতার সঙ্গে আইনের সমন্বয় ও কার্যকর প্রয়োগই এখন সময়ের দাবি।
২০১৮ সালের ২৯ জুলাই ঢাকার বিমানবন্দর সড়কে জাবালে নূর পরিবহনের দুটি বেপরোয়া বাসের ধাক্কায় শহীদ রমিজ উদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের শিক্ষার্থী দিয়া খানম মিম ও আব্দুল করিম রাজীব নিহত হন। এ ঘটনার প্রতিবাদে শিক্ষার্থীরা রাস্তায় নামে এবং দ্রুতই আন্দোলন সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে। এক অভূতপূর্ব গণআন্দোলনের মুখে সরকার নতুন সড়ক পরিবহন আইন প্রণয়নের ঘোষণা দেয় এবং পূর্ববর্তী ১৯৮৩ সালের মোটরযান অধ্যাদেশ বিলুপ্ত করে। ২০১৯ সালের ১ নভেম্বর থেকে আইনটি কার্যকর হয়। কিন্তু আজও আইন বাস্তবায়নে জটিলতা রয়ে গেছে।
আইনে বলা আছে, দুর্ঘটনায় মৃত্যু হলে চালকের সর্বোচ্চ ৫ বছরের কারাদণ্ড বা ৫ লাখ টাকা জরিমানা হতে পারে। ভুক্তভোগী পরিবার মনে করে, এই শাস্তি অনেক কম। আবার চালক-শ্রমিক সংগঠনগুলোর দাবি, সামান্য দুর্ঘটনাতেও যদি হত্যার মামলা হয়, তবে তাদের জীবিকা হুমকির মুখে পড়বে। একইভাবে লাইসেন্স ছাড়া গাড়ি চালালে সর্বোচ্চ ৬ মাসের জেল বা জরিমানা হবে বলা হলেও প্রতিদিন হাজার হাজার কিশোর মোটরসাইকেল নিয়ে উল্টো পথে ছুটে চলে। মামলা হলেও অল্প জরিমানায় ছাড়া পেয়ে যায়। ফলে ‘ভয়’ নামক উপাদানটি অনুপস্থিত থেকে যাচ্ছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক ড. শাহাদাত হোসেন বলেন, “আমাদের দেশে আইনের অভাব নেই, অভাব আছে প্রয়োগের সদিচ্ছার। চালক-শ্রমিক সংগঠনগুলোর রাজনৈতিক প্রভাব এতটাই প্রবল যে পুলিশও অনেক সময় কঠোর হতে পারে না। আবার আদালতে মামলার দীর্ঘসূত্রতা আইনের কার্যকারিতা নষ্ট করছে।”
নগর পরিকল্পনাবিদ স্থপতি ইকবাল হাবিব মনে করেন, “আমরা রাস্তাঘাট বানাচ্ছি, কিন্তু কোন পরিকল্পনা ছাড়া। পথচারীর নিরাপত্তা, সাইকেল লেন, আলাদা বাস লেন—এসব ব্যবস্থা নেই। উন্নত দেশগুলোতে আইন প্রয়োগের পাশাপাশি অবকাঠামোগত পরিকল্পনাই সড়ক শৃঙ্খলার মূল হাতিয়ার।”
ট্রাফিক বিশেষজ্ঞ ও সাবেক ডিআইজি (ট্রাফিক) আনোয়ারুল হক বলেন, “আমাদের ট্রাফিক ব্যবস্থাপনায় প্রযুক্তি ব্যবহার অত্যন্ত কম। সিসিটিভি, স্পিড গান, ই-টিকিটিং যদি সঠিকভাবে চালু করা যায়, তবে অনেকটা বিশৃঙ্খলা কমানো সম্ভব।”
ভুক্তভোগী পরিবারের প্রতিনিধি হিসেবে নিহত শিক্ষার্থী দিয়া খানম মিমের মা সামছুন্নাহার এক সাক্ষাৎকারে বলেন, “আমার মেয়ে চলে গেছে, কিন্তু এখনও প্রতিদিন অন্য কারও সন্তান সড়কে মরছে। আমরা আইনের কঠোর বাস্তবায়ন চাই। শুধু কাগজে কলমে আইন থাকলেই হবে না।”
ট্রাফিক পুলিশের সীমিত ক্ষমতার বিষয়টিও বারবার উঠে আসছে। তারা অনেক সময় শুধু মামলা লিখে দায়িত্ব শেষ করে। মামলা আদালতে গিয়ে বছরের পর বছর ঝুলে থাকে। অভিযুক্ত চালক বা মালিক দায় এড়াতে সক্ষম হয়। আইন ভীতির পরিবর্তে তাই অবজ্ঞার সংস্কৃতি তৈরি হয়েছে।
চালকদের অভিযোগ, অল্প বেতনে দীর্ঘ সময় কাজ করতে হয়। মালিকরা প্রতিদিন নির্দিষ্ট জমা নেন, ফলে তারা বাধ্য হন অতিরিক্ত যাত্রী তোলা, দ্রুত গাড়ি চালানো কিংবা সিগন্যাল অমান্য করতে। যাত্রীরা বলেন, বাসে উঠেই জীবন বাজি রাখতে হয়। দুর্ঘটনার পর ক্ষতিপূরণ না পেয়ে তারা দীর্ঘ ভোগান্তিতে পড়ে। মালিকরা অবশ্য দাবি করেন, কঠোর আইন প্রয়োগ করলে পরিবহন খাতে অচলাবস্থা তৈরি হবে।
পাশের দেশ ভারতের উদাহরণে দেখা যায়, ২০১৯ সালে মোটর ভেহিকেল অ্যাক্ট সংশোধনের পর মাতাল চালক ধরা পড়লে সর্বোচ্চ ১০ হাজার রুপি জরিমানা ও ৬ মাসের জেল হয়। দ্রুত বিচার নিশ্চিত করার জন্য বিশেষ ট্রাফিক আদালত গঠন করা হয়েছে। বাংলাদেশে এখনো আলাদা সড়ক আদালত নেই। দুর্ঘটনা মামলাগুলো সাধারণ আদালতে পড়ে থাকে বছরের পর বছর।
ভবিষ্যতের জন্য করণীয় স্পষ্ট। সড়ক পরিবহন আইনকে বাস্তবতার সঙ্গে খাপ খাইয়ে একটি সমন্বিত কাঠামোতে আনা দরকার। সড়ক দুর্ঘটনার মামলা দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য বিশেষ আদালত প্রয়োজন। প্রতিটি চালকের জন্য বাধ্যতামূলক প্রশিক্ষণ ও নিয়মিত রিফ্রেশার কোর্স চালু করা দরকার। প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে সড়ক নজরদারি যেমন সিসিটিভি, স্পিড গান, ই-টিকিটিং কার্যকর করতে হবে। দুর্ঘটনায় নিহত বা আহতদের পরিবারকে দ্রুত ক্ষতিপূরণ দিতে সরকারিভাবে একটি ট্রাস্ট ফান্ড গঠন করা উচিত। সবচেয়ে বড় বিষয় হলো পরিবহন মালিক-শ্রমিক সংগঠনের রাজনৈতিক প্রভাব কমিয়ে আইনকে নিরপেক্ষভাবে প্রয়োগ করা।
বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনা এখন শুধু আইনের ফাঁকফোকরের কারণে নয়, বরং সমন্বয়ের অভাব, রাজনৈতিক প্রভাব, অবকাঠামোগত দুর্বলতা এবং জনসচেতনতার অভাবের কারণে ঘটছে। শুধুমাত্র কঠোর শাস্তি দিয়ে নয়, বরং চালক-যাত্রী-মালিক-পুলিশ—সবার সমন্বিত উদ্যোগেই টেকসই সমাধান সম্ভব। সড়ক শুধু যোগাযোগের মাধ্যম নয়; এটি জাতীয় অর্থনীতির প্রাণস্রোত। তাই সড়কে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে হলে বিদ্যমান আইনগুলোর বাস্তবসম্মত সমন্বয় ও কার্যকর প্রয়োগ এখন সময়ের দাবি।।