নিজস্ব প্রতিবেদক
বাংলাদেশে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও উন্নয়ন সত্ত্বেও দারিদ্র্যের চিত্র ক্রমেই জটিল হয়ে উঠছে। সম্প্রতি পরিকল্পনা উপদেষ্টা ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেন, দেশের বিপুলসংখ্যক মানুষ এখন দারিদ্র্যসীমার নিচে নেই, কিন্তু একেবারে ওপরে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। তাঁর ভাষায়, ‘অনেকে নাক বরাবর পানিতে দাঁড়িয়ে আছে, সামান্য ঢেউ এলে তারা তলিয়ে যাবে।’
২০২৫-২৬ অর্থবছরে সামাজিক সুরক্ষায় বরাদ্দ রাখা হয়েছে এক লাখ ১৬ হাজার ৭৩১ কোটি টাকা, যা মোট বাজেটের ১৪.৭৮ শতাংশ এবং জিডিপির প্রায় ১.৮৭ শতাংশ।
গত দশকজুড়ে এই খাতে ধারাবাহিকভাবে বিনিয়োগ বৃদ্ধি পেলেও কার্যকারিতার প্রশ্ন রয়ে গেছে। চলতি অর্থবছরে কর্মসূচির সংখ্যা কমিয়ে ৯৫-এ আনা হয়েছে, যা আগে ছিল ১৪০। সরকার থেকে ব্যক্তি অর্থ প্রদানের ডিজিটাইজেশন, নগদভিত্তিক সহায়তা, দক্ষতা উন্নয়ন ও জীবিকা নির্বাহের সঙ্গে আর্থিক সহায়তাকে যুক্ত করার ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টারের (পিপিআরসি) সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে, দেশে দারিদ্র্যের হার গত তিন বছরে লাফিয়ে বেড়েছে।
২০২২ সালে দারিদ্র্যের হার ছিল ১৮.৭ শতাংশ, যা বর্তমানে ২৭.৯৩ শতাংশে পৌঁছেছে। অর্থাৎ প্রতি চারজনে একজন এখন দরিদ্র্যসীমার নিচে। একই সময় চরম দারিদ্র্যের হার ৫.৬ শতাংশ থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৯.৩৫ শতাংশে। প্রায় ১৮ শতাংশ মানুষ এমন অবস্থায় আছে, যেকোনো সময় তারা দারিদ্র্যের মধ্যে পড়ে যেতে পারে।
শহরের পরিবারের গড় আয় কমেছে, অথচ ব্যয় বেড়েছে। ২০২২ সালে মাসিক আয় যেখানে ছিল ৪৫ হাজার ৫৭৮ টাকা, বর্তমানে তা নেমে দাঁড়িয়েছে ৪০ হাজার ৫৭৮ টাকায়। কিন্তু খরচ বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ৪৫ হাজার টাকায়। এর বিপরীতে গ্রামে আয় সামান্য বেড়েছে। খরচের ৫৫ শতাংশ চলে যাচ্ছে শুধু খাদ্যে, ফলে সঞ্চয়ের কোনো সুযোগ নেই।
রিসার্চ অ্যান্ড পলিসি ইন্টিগ্রেশন ফর ডেভেলপমেন্টের (র্যাপিড) গবেষণায় উঠে এসেছে, শহরে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা ২০১০ সালের ৭৪ লাখ থেকে ২০২২ সালে বেড়ে ৭৯ লাখ হয়েছে। একই সময় ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠী বেড়ে দাঁড়িয়েছে এক কোটি ৫৩ লাখে। অথচ সামাজিক সুরক্ষার বরাদ্দের মাত্র ৪ শতাংশ শহরের দরিদ্রদের জন্য।
শহরে আয়ের বৈষম্যও বেড়েছে। ২০১০ সালে নগরের গিনি সূচক ছিল ০.৪৬, যা ২০২২ সালে দাঁড়িয়েছে ০.৫৪। এখন ধনী ৫ শতাংশ পরিবারের আয় দাঁড়িয়েছে মোট আয়ের ৩৩ শতাংশে, আর দরিদ্রতম ৫ শতাংশের আয় নেমে এসেছে অর্ধেক শতাংশে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর সর্বশেষ তথ্য বলছে, ২০২৪-২৫ অর্থবছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকে বেকারত্বের বেড়ে হয়েছে ৪.৬৩ শতাংশ। দেশে বেকারের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২৭ লাখে। নারীদের শ্রমশক্তিতে অংশগ্রহণ কমে যাওয়ায় এ হার আরো উদ্বেগজনক। একই সময় জিডিপি প্রবৃদ্ধি নেমে এসেছে ৩.৯৭ শতাংশে, যা কভিডকাল বাদ দিলে গত দুই দশকের মধ্যে সর্বনিম্ন।
প্রথমবারের মতো প্রকাশিত বহুমাত্রিক দারিদ্র্য সূচকের (এমপিআই) তথ্যে দেখা যায়, অন্তত চার কোটি মানুষ আয় ছাড়াও শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও জীবনযাত্রার মৌলিক সুযোগ থেকে বঞ্চিত। এ সূচক অনুযায়ী, ২০১৯ সালে বহুমাত্রিক দারিদ্র্যের হার ছিল ২৪ শতাংশ। ১৮ বছরের নিচে শিশুদের মধ্যে এ হার ২৯ শতাংশ, প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে ২১ শতাংশ। গ্রামে বহুমাত্রিক দারিদ্র্যের হার ২৭ শতাংশ হলেও শহরে তা ১৩ শতাংশ। বান্দরবানে এ হার সবচেয়ে বেশি, ৬৫ শতাংশ।
অর্থনীতিবিদ ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচিতে প্রকৃত দরিদ্র, অক্ষম, নারী, শিশু ও ঝুঁকিতে থাকা মধ্যবিত্ত শ্রেণিকে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। এ জন্য রাজনৈতিক সদিচ্ছা অপরিহার্য। বর্তমানে ৯০টিরও বেশি কর্মসূচি চালু আছে, এগুলোকে ২০-২৫টিতে একীভূত করা গেলে কার্যকারিতা বাড়বে।
তাঁরা বলছেন, সামাজিক সুরক্ষা দাতব্য নয়, বরং ন্যায়বিচার। এখন দেশে এক কোটি ৭৭ লাখ মা ও শিশু, প্রায় ২৯ লাখ দুর্বল নারী, ৬১ লাখ প্রবীণ ও ৩৫ লাখ প্রতিবন্ধী এ কর্মসূচির আওতায় আছেন। কিন্তু দেশের এক-চতুর্থাংশ মানুষ এখনো বহুমাত্রিক দারিদ্র্যের শিকার।
পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের (জিইডি) প্রতিবেদনে বলা হয়, দেশের অর্থনীতিতে কিছু ইতিবাচক পরিবর্তন এলেও নানা চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে। যুব বেকারত্ব, শহর-গ্রামের বৈষম্য, বহুমাত্রিক দারিদ্র্যের উচ্চহার ও জলবায়ু ঝুঁকি স্থিতিশীল উন্নয়নের পথে বড় বাধা।
চালের বাজারে অস্থিরতা উদ্বেগ তৈরি করেছে। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে সরকারি সংগ্রহ লক্ষ্যের তুলনায় মাত্র ৩৬ শতাংশ সংগ্রহ হয়েছে। জিইডি সতর্ক করেছে, বৈরী আবহাওয়া চালের দাম আরো বাড়াতে পারে। মুদ্রাস্ফীতি কিছুটা কমে বর্তমানে ৮.৫ শতাংশে নেমেছে এবং ২০২৫ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে তা ৭ শতাংশের নিচে নামানোর লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে।
পরিকল্পনা উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ সতর্ক করেছেন, দারিদ্র্যসীমার ওপরে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষদের প্রতি মনোযোগ না দিলে সামান্য অর্থনৈতিক ধাক্কাতেই তারা তলিয়ে যাবে। তাই দরকার শক্তিশালী রাজস্বনীতি, সর্বজনীন সামাজিক সুরক্ষা ও প্রকৃত দরিদ্রকে চিহ্নিত করার সঠিক ব্যবস্থা। অন্যথায় দারিদ্র্য আরো গভীর হতে পারে এবং টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য অর্জন কঠিন হয়ে পড়বে। এখন সময় এসেছে সর্বজনীন সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির। সর্বজনীন সুরক্ষার মধ্যে স্কুল ও স্বাস্থ্যসেবাকে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে, যা মৌলিক ন্যায়বিচারের অংশ।