- অদিতি করিম
আগামী ১৫ অক্টোবর জুলাই সনদে রাজনৈতিক দলগুলোর স্বাক্ষর করার কথা। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এই সনদ কিভাবে বাস্তবায়িত হবে, সে ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত ছাড়া সব রাজনৈতিক দল জুলাই সনদে স্বাক্ষর করবে কি না তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। দীর্ঘ এক বছর ধরে আলোচনার পরও ঐকমত্য কমিশন রাজনৈতিক দলগুলোকে এক ছাতার নিচে আনতে পারেনি।
এর মধ্যেই গত বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫ আগামী ১৫ অক্টোবর জাতীয় সংসদের দক্ষিণ প্লাজায় স্বাক্ষরিত হবে।
স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে নেতৃত্ব দেবেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা এবং জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সভাপতি অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। অনুষ্ঠানে দেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও জোটের প্রতিনিধিরা অংশ নেবেন। জাতীয় সংসদ ভবনে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন কার্যালয়ের সভাকক্ষে কমিশনের এক বৈঠকে এই সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করা হয়। এই পরিস্থিতিতে গোটা বাংলাদেশ এখন প্রধান উপদেষ্টার দিকে তাকিয়ে।
তাকিয়ে তাঁর নেতৃত্ব ও অভিভাবকত্বের দিকে। তিনিই একমাত্র জাতীয় ঐক্যের প্রতীক। জুলাই বিপ্লবের রাজনৈতিক শক্তিগুলো এখন বহুধাবিভক্ত। তাদের মধ্যে অবিশ্বাস বাড়ছে।
রাজনৈতিক দলগুলো যে যার অবস্থানে অনড়। এ রকম পরিস্থিতিতে জুলাই স্বাক্ষরে সম্মত করাতে পারেন একমাত্র ড. ইউনূস। সব দলকে আস্থায় নিয়ে তিনিই পারেন নির্বাচনের পথে দেশকে এগিয়ে নিতে। জুলাই আন্দোলনের শক্তিগুলোর অনেকে এখন উপদেষ্টাদের ওপর আস্থা রাখতে পারছে না। একে অন্যকে সন্দেহ করছে।
কিন্তু একটি বিষয়ে এখনো রাজনৈতিক শক্তিগুলো একমত, সেটি হলো ড. ইউনূসের নেতৃত্ব। প্রধান উপদেষ্টা এখনো সবার কাছে গ্রহণযোগ্য। তাঁকে নিয়ে কোনো বিতর্ক নেই। সবাই তাঁকে সম্মান করে, অভিভাবক হিসেবে মানে। এ কারণেই কমিশন জুলাই সনদ চূড়ান্ত করার দায়িত্ব জাতির অভিভাবকের হাতে তুলে দিয়েছে। এর আগেও আমরা দেখেছি, কমিশনের বৈঠকে যখনই অচলাবস্থা তৈরি হয়েছে, তখনই প্রধান উপদেষ্টা হস্তক্ষেপ করেছেন। রাজনৈতিক দলগুলোকে বাস্তবতা বুঝিয়েছেন। সে কারণেই শেষ পর্যন্ত বেশির ভাগ সংস্কার প্রস্তাবে দলগুলো একমত হতে পেরেছে।
রাষ্ট্রের বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংস্কার প্রশ্নে ঐকমত্য তৈরির লক্ষ্যে গত ১৫ ফেব্রুয়ারি যাত্রা শুরু করে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে দুই পর্বের আলোচনায় ৮৪টি সংস্কার প্রস্তাব নিয়ে ঐকমত্য ও সিদ্ধান্ত হয়। এর মধ্যে কিছু প্রস্তাবে কোনো কোনো দলের ভিন্নমত আছে। এই ৮৪টি সংস্কার প্রস্তাব নিয়ে তৈরি হচ্ছে জুলাই জাতীয় সনদ। প্রথম পর্বে ৩৩টি এবং দ্বিতীয় পর্বে ৩০টি দল আলোচনায় অংশ নেয়। তবে সংবিধান সম্পর্কিত সংস্কার প্রস্তাবগুলোর বাস্তবায়ন পদ্ধতি নিয়ে দলগুলোর সঙ্গে কমিশনের পাঁচ দিন আলোচনা হলেও ঐকমত্য হয়নি। সর্বশেষ গত বুধবার রাতে আলোচনায় দলগুলোর অনড় অবস্থানের মুখে ঐকমত্য কমিশন জানায়, বিশেষজ্ঞ ও রাজনৈতিক দলগুলোর মতামত সমন্বয় করে বাস্তবায়নের উপায় নিয়ে সরকারকে সুপারিশ দেবে কমিশন।
তবে সনদ বাস্তবায়নের উপায় নিয়ে এখন পর্যন্ত সুপারিশ চূড়ান্ত করেনি কমিশন। সনদ বাস্তবায়নে গণভোট নিয়ে ঐকমত্য থাকলেও গণভোটের ভিত্তি, সময় ও পদ্ধতি নিয়ে রাজনৈতিক মতবিরোধ আছে। এমন পরিস্থিতিতে শেষ পর্যন্ত সব দল সনদে সই করবে কি না, তা এখনো পরিষ্কার নয়। কমিশনের সুপারিশে বাস্তবায়নের উপায়, বিশেষ করে গণভোটের সময় ও ভিন্নমত থাকা প্রস্তাবগুলোর বিষয়ে কী থাকছে, এগুলো আগে দেখতে চায় দলগুলো। এসবের ওপর সনদে সই করা না করার বিষয়টি নির্ভর করছে বলে দলগুলোর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে। গণভোটের সময় ও পদ্ধতি নিয়ে মতভিন্নতা থাকলেও এ বিষয়ে রাজনৈতিক ঐকমত্য হওয়ায় সনদ বাস্তবায়নের পদ্ধতি হিসেবে এটাকেই প্রাধান্য দিচ্ছে কমিশন।
এ ক্ষেত্রে অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি, অধ্যাপক ও আইনজীবীদের সমন্বয়ে গঠিত বিশেষজ্ঞ প্যানেল যে মতামত দিয়েছে, সেটাকেই ভিত্তি হিসেবে বিবেচনা করছে কমিশন। গণভোটের সময়ের বিষয়টি অন্তর্বর্তী সরকারের সিদ্ধান্তের ওপর ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে কমিশন। অর্থাৎ প্রধান উপদেষ্টার ওপর অচলাবস্থা নিরসনের দায়িত্ব তুলে দেওয়া হলো। এই অচলাবস্থা নিরসনের ওপর নির্ভর করছে আগামী নির্বাচন, গণতন্ত্রের উত্তরণ। প্রধান উপদেষ্টা গত ৫ আগস্ট জাতির উদ্দেশে প্রদত্ত ভাষণে আগামী বছরের ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে জাতীয় নির্বাচনের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেন। এরপর একাধিকবার তিনি বলেছেন, ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচনের কোনো বিকল্প নেই। নির্বাচন হতেই হবে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় বাংলাদেশে দ্রুত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার কথা বলে আসছে। দেশের জনগণ নির্বাচনের জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে। গত ১৪ মাসে বাংলাদেশ এক অনিশ্চিত, উৎকণ্ঠার সময় পার করেছে। কোনো কিছুই ঠিকঠাকমতো চলছে না। আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হচ্ছে প্রতিনিয়ত। মব সন্ত্রাসে জর্জরিত গোটা দেশ। অর্থনৈতিক পরিস্থিতি খারাপ। বিনিয়োগ বন্ধ, কর্মসংস্থান নেই। লাখ লাখ মানুষ নতুন করে বেকার হয়েছে। শিল্পোদ্যোক্তা, ব্যবসায়ীরা নানা হয়রানির শিকার। সবাই একমত, অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষে এসব সমস্যার সমাধান করা সম্ভব নয়। একটি নির্বাচিত সরকারের সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা ও কর্মসূচিই পারে এই অনিশ্চয়তা দূর করতে। বিশ্বের কোনো দেশই একটি আপৎকালীন সরকারের সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদি সম্পর্ক গড়তে আগ্রহী নয়। প্রধান উপদেষ্টা জেনেবুঝেই নির্বাচনকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিচ্ছেন। জুলাই সনদে যদি সব রাজনৈতিক দল স্বাক্ষর করে, দেশ নির্বাচনের পথে এগিয়ে যেতে পারে। নির্বাচন না হলে দেশ এক ভয়াবহ সংকটে পড়বে। গত শুক্রবার বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন না হলে দেশে নির্বাচন হবে না। আর নির্বাচন না হলে বাংলাদেশ এক অন্ধকার টানেলে প্রবেশ করবে, যেখান থেকে বেরোতে পারবে না কেউ। তাই বাংলাদেশ এখন ড. ইউনূসের দিকে তাকিয়ে। তিনিই দেশের আশা-ভরসার শেষ স্থান।
অদিতি করিম : লেখক ও নাট্যকার
ই-মেইল : auditekarim@gmail.com