মুহম্মদ আকবর
বাংলাদেশের ৭৩ শতাংশ মানুষের দৈনিক স্বাস্থ্যকর খাবার কিনে খাওয়ার সামর্থ্য নেই। স্বাস্থ্যকর খাবার খেতে না পেয়ে বর্তমানে দেশের ১১.৪ শতাংশ মানুষ অপুষ্টিতে ভুগছে। এটি জাতিসংঘের গবেষণা থেকে প্রাপ্ত তথ্য। আর ওয়ার্ল্ড ফুড প্রোগ্রামের ২০২৩ সালের ফুড সিকিউরিটি মনিটরিং অনুযায়ী, বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৩৬ শতাংশই ভুগছে খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায়। এ ছাড়া আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্রের (আইসিডিডিআর,বি) মাতৃপুষ্টিবিষয়ক এক গবেষণার তথ্য মতে, দেশে ৩৯ শতাংশ শিশু জন্ম নিচ্ছে কম ওজন নিয়ে। সরকারের সর্বশেষ (২০১৯) তথ্যানুযায়ী, ৫ বছরের কম বয়সী শিশুদের মধ্যে অপুষ্টিজনিত কৃশকায় শিশুর হার ৯.৮ শতাংশ এবং খর্বকায় শিশুর হার ২৮ শতাংশ। গুরুতর অপুষ্টিতে ভুগছেÑ এমন শিশুর সংখ্যা প্রায় ৬ লাখ।
এমন পরিস্থিতিতে আজ ১৬ অক্টোবর পালন করা হচ্ছে বিশ্ব খাদ্য দিবস। কৃষি মন্ত্রণালয় ও জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) যৌথ উদ্যোগে বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও দিবসটি পালিত হবে। এ উপলক্ষে পুষ্টিবিদ, চিকিৎসক ও বিভিন্ন সেবামূলক প্রতিষ্ঠান সভা-সেমিনারেরও আয়োজন করেছে। এবার এ খাদ্য দিবসের প্রতিপাদ্যÑ ‘হাত রেখে হাতে/ উত্তম খাদ্য ও উন্নত আগামীর পথে’।
বিশেষজ্ঞরা জানান, দেশে পুরুষের তুলনায় নারীদের মধ্যে পুষ্টিহীনতা বেশি। স্বাস্থ্যকর খাবারের অংশ হিসেবে কম চর্বি, চিনি ও লবণযুক্ত খাবারের সঙ্গে ফল ও শাকসবজি খেলে কিছু অসংক্রামক রোগের ঝুঁকি কমানো যেতে পারে বলে মনে করেন তারা।
বিশ্ব খাদ্য দিবসকে সামনে রেখে গতকাল ওয়েবিনারের আয়োজন করে গবেষণা ও অ্যাডভোকেসি প্রতিষ্ঠান প্রজ্ঞা। অনুষ্ঠানে বক্তারা জানান, অনিরাপদ ও অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাসের কারণে বাংলাদেশে উচ্চ রক্তচাপসহ বিভিন্ন অসংক্রামক রোগ ও মৃত্যুঝুঁকি ক্রমশ বাড়ছে। অনুষ্ঠানে বক্তারা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাসহ বিভিন্ন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান কর্তৃক প্রকাশিত তথ্যাদি তুলে ধরেন। তাঁরা জানান, খাবারে অতিরিক্ত লবণ এবং ট্রান্সফ্যাটের উপস্থিতি উচ্চ রক্তচাপের নিয়ন্ত্রণযোগ্য ঝুঁকি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। সঠিক খাদ্যাভ্যাসের মাধ্যমে এটি অনেকটাই কমানো সম্ভব।
‘খাদ্যাভ্যাস ও উচ্চ রক্তচাপ ঝুঁকি’ শীর্ষক এ আয়োজনে বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের সদস্য (খাদ্য শিল্প ও উৎপাদন) অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ শোয়েব জানান, ট্রান্সফ্যাট নিয়ন্ত্রণ প্রবিধানমালা বাস্তবায়নের পাশাপাশি ফ্রন্ট অব প্যাক লেবেলিং নিয়ে কাজ করার উদ্যোগ নিয়েছে বিএফএসএ, যা স্বাস্থ্যকর খাবার গ্রহণ ও অসংক্রামক রোগ মোকাবিলায় কার্যকর ভূমিকা পালন করবে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কমিউনিটি বেইজড হেলথ
কেয়ারের (সিবিএইচসি) প্রোগ্রাম ম্যানেজার ডা. গীতা রানী দেবী বলেন, উচ্চ রক্তচাপ প্রতিরোধে স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাসের গুরুত্ব নিয়ে আমরা কাজ করছি। কমিউনিটি পর্যায় থেকেই কাজটি শুরু করা উচিত এবং সে অনুযায়ী পলিসি অ্যাডভোকেসির মাধ্যমে অ্যাকশন প্ল্যান তৈরি করতে হবে।
ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন হসপিটাল অ্যান্ড রিসার্চ ইনস্টিটিউটের ইপিডেমিওলজি অ্যান্ড রিসার্চ বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ডা. সোহেল রেজা চৌধুরী বলেন, মানুষকে সচেতন করার পাশাপাশি এমন একটি পদ্ধতি বাস্তবায়ন করতে হবে, যেন প্রক্রিয়াজাত খাবার কেনার আগে মানুষ বুঝতে পারেÑ কোন খাবারে কতটা লবণ ও অন্যান্য উপকরণ আছে।
ওয়েবিনারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুষ্টি ও খাদ্য বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. খালেদা ইসলাম বলেন, উচ্চ রক্তচাপসহ অন্যান্য অসংক্রামক রোগের প্রকোপ কমাতে স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস নিশ্চিতের পাশাপাশি জীবনাচরণে পরিবর্তন আনতে হবে।
‘সুষম খাদ্যাভ্যাস’ গড়ে তুলতে করণীয় কীÑ এমন প্রশ্নে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুষ্টি ও খাদ্য বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের সদ্য বিদায়ী এই পরিচালক আমাদের সময়কে বলেন, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের সুস্থতা নির্ভর করছে আজকের খাদ্যাভ্যাসের ওপর। এ জন্য স্কুল পর্যায়ে পুষ্টি শিক্ষা ও স্কুল মিল প্রোগ্রাম চালু রাখা দরকার। পরিবারে পাঁচটি খাদ্য গ্রুপÑ ধান্য, প্রোটিন, সবজি, ফল ও দুধের ভারসাম্য শেখানো জরুরি। জাঙ্ক ফুডের প্রচার নিয়ন্ত্রণ ও স্থানীয় পুষ্টিকর খাবারকে উৎসাহ দিতে হবে। কমিউনিটি পর্যায়ে বাগান, ফলমূল ও সবজি উৎপাদন কার্যক্রম শিশুদের হাতে-কলমে পুষ্টি শিক্ষা দেবে।
এসআইবিএল হসপিটাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের সিনিয়র ডায়েটিশিয়ান এবং পুষ্টিবিদ ফাউন্ডেশনের জেনারেল সেক্রেটারি রেবেকা সুলতানা আমাদের সময়কে বলেন, কেবল শস্যজাতীয় খাদ্যের ওপর নির্ভর না করে পর্যাপ্ত পরিমাণে প্রাণিজ আমিষ (মাছ, মাংস, ডিম), দুগ্ধজাত খাবার, শাকসবজি ও ফল খাদ্যতালিকায় অন্তর্ভুক্ত করার বিষয়ে সাধারণ মানুষকে সচেতন করতে হবে। পুষ্টিসমৃদ্ধ খাদ্যের লভ্যতা ও ক্রয়ক্ষমতার বিষয়ে তিনি বলেন, কৃষিতে উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহার ও কৃষি বৈচিত্র্যকরণের মাধ্যমে পুষ্টিসমৃদ্ধ ফসল ও প্রাণিজ খাদ্যের উৎপাদন বাড়াতে হবে। পাশাপাশি সব শ্রেণির মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে পুষ্টিকর খাবারের দাম কমানোর উদ্যোগ নিতে হবে।
পুষ্টিবিদ রেবেকা সুলতানা জানান, বাংলাদেশে নারীদের পুষ্টিহীনতা তুলনামূলকভাবে বেশি। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার ‘পুষ্টি জরিপ-২০১১’ অনুসারে, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে পুষ্টিহীনতার দিক থেকে বাংলাদেশের অবস্থান সবচেয়ে উপরে ছিল এবং জরিপে ৫০ শতাংশের বেশি নারী পুষ্টিহীনতায় ভুগছেন বলে জানানো হয়।
আইসিডিডিআর,বির ২০২২ সালের তথ্য মতে, ১৫ থেকে ৪৯ বছর বয়সী ১ কোটি ৭০ লাখ নারী অপুষ্টির শিকার, যার মধ্যে ৫০ লাখ নারীর ওজন প্রয়োজনের তুলনায় কম (অপুষ্টিতে ভুগছেন) এবং ১ কোটি ২০ লাখ নারী স্থূল (যা অপুষ্টিরই দ্বৈত বোঝা)। সবমিলিয়ে প্রায় ৪৫ শতাংশ নারী অপুষ্টিতে ভুগছেন।
নারীর অপুষ্টির এই হার কৈশোর পার হয়ে মা হওয়ার সময় অপুষ্ট শিশু জন্মের মাধ্যমে অপুষ্টির একটি দুষ্টচক্র তৈরি করে। এ থেকে উত্তরণের বিষয়ে রেবেকা সুলতানা বলেন, গর্ভকালীন ও প্রসবকালীন সময়ে মায়ের পুষ্টি নিশ্চিত করা এবং শিশুদের জন্য জন্মের ১ ঘণ্টার মধ্যে মায়ের দুধ পান করানো, ৬ মাস বয়স পর্যন্ত শুধু মায়ের দুধ পান করানো এবং ৬ মাস বয়স থেকে পরিপূরক খাবার (ন্যূনতম চারটি খাদ্যশ্রেণির সমন্বয়ে তৈরি খাবার) নিশ্চিত করা। পুষ্টি উন্নয়নে কৃষি, স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও সামাজিক নিরাপত্তা খাতসহ বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি সংস্থাকে একযোগে কাজ করতে হবে। সেই সঙ্গে নারী ও মেয়েশিশুদের খাদ্যের ওপর গুরুত্বারোপ করতে হবে এবং তাদের পুষ্টি নিশ্চিত করতে বিশেষ নজর দিতে হবে।
বিশ্ব খাদ্য দিবস উপলক্ষে কৃষি মন্ত্রণালয় ও জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার যৌথ উদ্যোগে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল মিলনায়তনে (খামারবাড়ি, ঢাকা) আজ সকাল ১০টায় একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। এতে খাদ্য নিরাপত্তা, পুষ্টি, কৃষি প্রযুক্তি উদ্ভাবন ও টেকসই খাদ্য উৎপাদন ব্যবস্থার বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা করবেন দেশের বিশিষ্টজনরা।