এজেন্টিক এআই কী
এখন যেসব এআই সেবার সঙ্গে আমরা পরিচিত, সেসব সিস্টেম প্রশ্নের উত্তর দেয় বা নির্দেশ অনুসারে কাজ করে। এ জন্য ধাপে ধাপে প্রম্পট করতে হয়। এজেন্টিক এআই তার চেয়ে এক ধাপ এগিয়ে। কী করতে হবে, এআই এজেন্টকে শুধু সেই উদ্দেশ্য ঠিক করে দিলেই নিজে থেকেই সব গুছিয়ে করে নিতে পারবে।
ব্যবহারকারীর তত্ত্বাবধানের প্রয়োজন নেই। এআই নিজেই কাজের লক্ষ্য ঠিক করে, সে অনুযায়ী পরিকল্পনা করে সেটি করতে পারে। একই এজেন্ট সব কাজ করবে এমন নয়, বরং বেশ কয়েকটি এজেন্ট মিলে পরিপূর্ণ এজেন্টিক এআই প্ল্যাটফর্ম তৈরি করাই তাদের লক্ষ্য। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, আপনি যদি বলেন, ‘আগামী সপ্তাহের মিটিংগুলোর জন্য সময় নির্ধারণ করো’, এজেন্টিক এআই মিটিংয়ের সময়গুলো অংশগ্রহণকারীদের ক্যালেন্ডারে বসাবে, পাশাপাশি সহকর্মীদের সময়সূচি মিলিয়ে ই-মেইল পাঠাবে, মিটিং লিংক তৈরি করবে এবং প্রয়োজনীয় নোটও প্রস্তুত করবে।
কিভাবে কাজ করে
কাজের প্রেক্ষাপট (কনটেক্সট) বুঝে স্বয়ংক্রিয়ভাবে সিদ্ধান্ত নিতে পারে এজেন্টিক এআই। অর্থাৎ এটি যুক্তিতর্ক বুঝে কাজের পরিবেশ সম্পর্কে ধারণা অনুযায়ী চিন্তা করতে পারে। এর মূল বিশেষত্ব, ব্যবহারকারীদের ফিডব্যাক থেকে শিক্ষা নিয়ে নিজেকে উন্নত করতে পারে। এ কাজগুলো বর্তমান এআই সেবার মধ্যে নেই।
এজেন্টিক এআই অনেক স্বয়ংক্রিয় সফটওয়্যার নিয়ে গঠিত।
এর প্রধান প্রযুক্তি মেশিন লার্নিং, পাশাপাশি আছে ন্যাচারাল ল্যাঙ্গুয়েজ প্রসেসিং এবং নলেজ রিপ্রেজেন্টেশন। এগুলো সম্মিলিতভাবে কাজ করে, ফলে এজেন্টরা যুক্তিতর্ক অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নেওয়া ও ব্যবহারকারীদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারে।
কী কাজে ব্যবহৃত হবে
এখন এআই সেবা বলতে আমরা বুঝি জেনারেটিভ এআই। ব্যবহারকারীর প্রম্পট অনুযায়ী লেখা, ছবি, সংগীত, ভিডিও বা সফটওয়্যার কোড তৈরি করতে পারে। এজেন্টিক এআই-এর কাজ সম্পূর্ণ ভিন্ন, দায়িত্ব নিয়ে করতে পারে জটিল কাজ।
স্বাস্থ্যসেবা, অর্থনীতি ও উৎপাদন শিল্পের বিভিন্ন কার্যক্রমের দায়িত্ব নিতে সক্ষম। যাকে বলা হচ্ছে এআই অটোমেশন। ফলে প্রতিটি কর্মক্ষেত্রে এটি বিপ্লব ঘটানোর সম্ভাবনা আছে। ব্যক্তিগত সহকারী, কাস্টমার কেয়ার এজেন্ট, রিসিপশনিস্ট বা ফ্যাক্টরির বিভিন্ন কাজের ম্যানেজার হিসেবে কাজ করতে সক্ষম এটি। শুধু এআই ব্যবহার করে পুরো দলের কাজ একাই করা যাবে।
তৈরিতে কারা কাজ করছে
বিশ্বের শীর্ষ প্রযুক্তি নির্মাতা প্রতিষ্ঠানগুলো এজেন্টিক এআইকে কেন্দ্র করে ভবিষ্যৎ গড়ে তুলছে। ওপেনএআই তাদের জিপিটি মডেলের ওপর ভিত্তি করে তৈরি করছে ‘এআই এজেন্টস’। এটি ব্যবহারকারীর হয়ে ই-মেইল পাঠানো থেকে শুরু করে অনলাইনে ফ্লাইট বুকিং পর্যন্ত করতে পারবে। গুগলের জেমিনির এজেন্টগুলো তাদের নিজস্ব ইকোসিস্টেমে কাজ করতে সক্ষম, যেমন—গুগল ওয়ার্কপ্লেস বা অ্যানড্রয়েড।
মাইক্রোসফটের তৈরি কোপাইলট হতে যাচ্ছে এ সফটওয়্যার জায়ান্টের ‘স্বয়ংক্রিয় এজেন্ট’। অফিস ৩৬৫ ও গিটহাবের মাধ্যমে এটি মিটিং সেট করা থেকে শুরু করে ফাইল সংগঠিত করা, প্রজেক্ট ট্র্যাকিং, এমনকি সফটওয়্যারও নিজে থেকে তৈরি করতে পারবে।
এজেন্টিক এআইকে ব্যক্তিগত সহকারী হিসেবে তৈরি করছে অ্যানথ্রোপিক এবং মেটা। এগুলো ব্যবহারকারীর ব্যক্তিগত সহকারী হিসেবে দৈনন্দিন কাজে সাহায্য করবে। তাদের কাজকর্ম এবং জীবনযাপনের অভ্যাসগুলো শিখে সে অনুযায়ী বিভিন্ন কাজে সাহায্য করা ও সিদ্ধান্ত নেওয়ায় সহায়তা দেবে।
বাস্তব প্রয়োগ
কাজকর্মের অটোমেশন সরাসরি ব্যবহারকারীদের জীবনে প্রভাব ফেলবে না। তবে ব্যক্তিগত সহকারী এআই এজেন্ট সরাসরি জীবনধারাই বদলে দেবে। সকালে ঘুম থেকে ওঠার পরপরই হয়তো এআই এজেন্ট জানিয়ে দেবে, ‘আজ বৃষ্টি হতে পারে, তাই অফিসে যেতে একটু আগে বের হওয়া উচিত। আমি রাইড শেয়ারিংয়ে গাড়ি বুক করে দিচ্ছি।’ গাড়ি বুক করে, পছন্দের কফি বাসায় পৌঁছে দেওয়ার জন্য অর্ডার করে, ক্যালেন্ডার দেখে ই-মেইলে ক্লায়েন্টকে মিটিং রিমাইন্ডার পাঠাবে কোনো প্রম্পট ছাড়াই।
প্রযুক্তিটি হয়ে উঠছে ব্যবসার অবিচ্ছেদ্য অংশ। বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান এর মধ্যেই শুরু করেছে এআই এজেন্ট ব্যবহার। জীবনবৃত্তান্ত বিশ্লেষণ করে পদের জন্য প্রার্থী বাছাই করা, গ্রাহকের সমস্যা বুঝে তাৎক্ষণিকভাবে সমাধান করা, এমনকি প্রজেক্ট ম্যানেজমেন্টও সম্পূর্ণ অটোমেশনে করা হচ্ছে।
স্বাস্থ্যসেবা খাতে এজেন্টিক এআই বিশ্লেষণ করছে ঘুম, ডায়েট ও শারীরিক ডেটা, আর সে অনুযায়ী স্বাস্থ্য পরামর্শ দিচ্ছে। কনটেন্ট নির্মাতাদের জন্য এটি হয়ে উঠছে এক বিশ্বস্ত সহকারী। স্ক্রিপ্ট, আইডিয়া, এমনকি ভিডিও এডিটিং পর্যন্ত করে দিচ্ছে এক ক্লিকে।
২০২৬: এআই এজেন্টের বছর
প্রযুক্তি বিশ্লেষকরা বলছেন, ২০২৬ সাল হবে ‘এআই এজেন্টের’ বছর। ব্যবসা ও অর্থনৈতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান গার্টনারের পূর্বাভাস অনুযায়ী, ২০২৮ সালের মধ্যে দৈনন্দিন কর্মক্ষেত্রে ১৫ শতাংশ সিদ্ধান্ত স্বয়ংক্রিয়ভাবে এজেন্টিক এআই দ্বারা নেওয়া হবে। গত বছরও এর অস্তিত্বই ছিল না।
মিডিয়া, শিক্ষা ও সরকারি প্রশাসনেও এজেন্টিক এআই ব্যবহারের প্রবণতা বাড়বে। বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলো কাজ করছে এজেন্টিক ওয়েব তৈরি নিয়ে। এতে এআই এজেন্টরা কাজ করবে গবেষণা, শিডিউলিং ও প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম কেনাকাটায়।
তবে এই প্রযুক্তি নিয়ে সমালোচনারও শেষ নেই। এআই এজেন্ট ব্যবহারের ফলে অনেক ব্যক্তি চাকরি হারাবেন। কর্মসংস্থান চিরতরে কমে যাবে। এআই এখনো অনেক ভুল করে। যদি গুরুত্বপূর্ণ ও জরুরি কাজে এআই এজেন্ট ব্যবহার করা হয়—তখন ছোট ভুল থেকেও হতে পারে বড় ক্ষতি।
গবেষণা বা স্বাস্থ্যসেবার মতো কাজে একটিও হেলুসিনেশন (ভুয়া তথ্য) চরম বিপদ ডেকে আনতে পারে। এ ছাড়াও পরিবেশের ওপর এআইয়ের জন্য প্রয়োজনীয় বিদ্যুৎ উৎপাদনের চাপ এবং সুপেয় পানির ব্যবহার নিয়ে পরিবেশবাদীরা চিন্তিত। যে সকল প্রতিষ্ঠানগুলো এআই এজেন্ট ব্যবহার করছে, তারা ভবিষ্যতবানী করেছে—এর প্রভাবে চাকরি কমে যাবে প্রায় ৩০ শতাংশ, বাড়বে বেকারত্বের হার।
কিছু কিছু সংগঠন এখনই এআইয়ের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের ঘোষণা দিয়েছে। শেষ পর্যন্ত চাকরির বাজারে এআই এজেন্টের কতটা বড় প্রভাব পড়বে, সেটি এখনই আন্দাজ করা কঠিন। এআই ব্যবহারের খরচ কমানো এবং হোলুসিনেশন বন্ধ করা না গেলে এআই এজেন্টের সার্বজনীন ব্যবহার সম্ভব হবে না।