বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে ১৫ সেনা কর্মকর্তাকে গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এসব কর্মকর্তার বিরুদ্ধে গুম-খুন এবং মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ রয়েছে, যা আওয়ামী লীগের দীর্ঘ শাসনামলে বিভিন্ন সময়ে সংঘটিত হয়েছিল। তাদের বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনালে পৃথক তিনটি মামলার শুনানি অনুষ্ঠিত হয়।
বুধবার সকাল ১০টা ১০ মিনিটে, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের মূল ফটকে কঠোর নিরাপত্তার মধ্যে ১৫ সেনা কর্মকর্তাকে নিয়ে যাওয়া হয়। এর আগে, সকালে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত গাড়িতে করে এই কর্মকর্তাদের আদালতে আনা হয়। সকাল ৮টার পর মামলার শুনানি শুরু হয় এবং পরবর্তীতে বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদার নেতৃত্বাধীন ট্রাইব্যুনাল-১ এর বিচারিক প্যানেল তাদের কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন।
প্রসিকিউশনের পক্ষ থেকে শুনানি করেন চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম। তিনি সাংবাদিকদের জানান যে, এই ১৫ আসামির মধ্যে ১০ জন র্যাবের টিএফআই সেলে গুম-নির্যাতনের অভিযোগে দায়ের করা মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় গ্রেপ্তার হয়েছেন। এছাড়া, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং অন্যান্য পলাতক আসামিদের হাজির হওয়ার জন্য পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের নির্দেশও দেওয়া হয়েছে। আগামী ২৯ অক্টোবরের মধ্যে এই বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হবে।
এছাড়া, জয়েন্ট ইন্টারোগেশন সেলে গুমের অভিযোগে আরেকটি মামলায় ১৩ আসামির মধ্যে তিনজনকে ট্রাইব্যুনালে হাজির করা হয়। তাদের বিরুদ্ধেও একই আদেশ দেওয়া হয় এবং পলাতকদের বিষয়ে পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের নির্দেশ দেয়া হয়।
এছাড়া, ২০০৯ সালের জুলাই-আগস্ট মাসে রাজধানী ঢাকার রামপুরায় সংঘটিত আন্দোলন ও সহিংসতায় ২৮ জনের হত্যার ঘটনায় মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় দুজনকে গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। তবে, পলাতক দুই আসামি আদালতে হাজির না হওয়ায় তাদের বিষয়ে পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের নির্দেশ দেয়া হয়। আগামী ৫ নভেম্বর পরবর্তী শুনানির দিন ধার্য করা হয়েছে।
গ্রেপ্তারকৃত ১৫ সেনা কর্মকর্তার মধ্যে রয়েছেন, র্যাবের সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. জাহাঙ্গীর আলম, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল তোফায়েল মোস্তফা সারোয়ার, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. কামরুল হাসান, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মাহাবুব আলম, কর্নেল আবদুল্লাহ আল মোমেন, কর্নেল আনোয়ার লতিফ খান (অবসরকালীন ছুটিতে), র্যাবের গোয়েন্দা শাখার সাবেক পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মো. মশিউর রহমান, লেফটেন্যান্ট কর্নেল সাইফুল ইসলাম সুমন, লেফটেন্যান্ট কর্নেল মো. সারওয়ার বিন কাশেম, লেফটেন্যান্ট কর্নেল মোহাম্মদ রেদোয়ানুল ইসলাম, বিজিবির সাবেক কর্মকর্তা মেজর মো. রাফাত বিন আলম, ডিজিএফআইয়ের সাবেক পরিচালক মেজর জেনারেল শেখ মো. সরওয়ার হোসেন, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মাহবুবুর রহমান সিদ্দিকী এবং ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আহমেদ তানভির মাজাহার সিদ্দিকী।
এদিকে, গ্রেপ্তারকৃত সেনা কর্মকর্তাদের ট্রাইব্যুনালে উপস্থিতি নিশ্চিত করতে রাজধানীর বিভিন্ন পয়েন্টে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সতর্ক অবস্থানে ছিল। কাকরাইল, মৎস্য ভবন, পল্টন এবং ট্রাইব্যুনাল এলাকা সহ হাইকোর্টের মাজারগেট এলাকার নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়। পুলিশ, র্যাব, বিজিবি এবং সেনাবাহিনীর সদস্যরা সকাল থেকে নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে তৎপর ছিলেন।
এর আগে, ৮ অক্টোবর এই তিন মামলায় ৩৪ আসামির বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করে প্রসিকিউশন। অভিযোগগুলো আমলে নিয়ে ট্রাইব্যুনাল গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে এবং আসামিদের উপস্থিতির জন্য আজকের দিন ধার্য করে। একাধিক মামলা জড়িত এসব সেনা কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময় মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ উঠেছে, যেগুলোর মধ্যে গুম, নির্যাতন ও হত্যাকাণ্ড উল্লেখযোগ্য।
তবে, এসব মামলার পরিপ্রেক্ষিতে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ আইনগত এবং রাজনৈতিক প্রশ্ন উঠেছে, যার মধ্যে সরকারের উচ্চ পর্যায়ের ব্যক্তিদের ভূমিকা এবং পলাতক আসামিদের বিরুদ্ধে নেওয়া পদক্ষেপ গুরুত্বপূর্ণ। এর পাশাপাশি, ট্রাইব্যুনাল এবং বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও কার্যক্রমের ওপর জনগণের আস্থা ভবিষ্যতে কীভাবে প্রভাব ফেলবে তা একটি আলোচনার বিষয়।
এ পর্যন্ত, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল এই মামলাগুলোর তদন্ত ও শুনানির জন্য নিয়মিত কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে এবং এর পরবর্তী শুনানি ২০ নভেম্বর এবং ৫ নভেম্বর নির্ধারণ করা হয়েছে।