সংস্কৃতি ও প্রত্নতত্ত্ব ডেস্ক
কুমিল্লার লালমাই থেকে ময়নামতি পর্যন্ত বিস্তৃত অঞ্চলে প্রাপ্ত প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন বিশ্লেষণে ইতিহাসবিদরা অন্তত আটটি রাজবংশের প্রায় ৩০ জন রাজার অস্তিত্বের প্রমাণ পেয়েছেন। ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শতাব্দীর মধ্যে এ অঞ্চল ছিল দক্ষিণ-পূর্ব বাংলার এক গুরুত্বপূর্ণ সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক কেন্দ্র। এর মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য প্রত্নস্থল হলো ‘রাণী ময়নামতির প্রাসাদ’, যা বর্তমানে কুমিল্লা জেলার বুড়িচং উপজেলার ময়নামতি ইউনিয়ন পরিষদ-সংলগ্ন সাহেবের বাজার এলাকায় অবস্থিত।
বিশেষজ্ঞদের ধারণা অনুযায়ী, রাণী ময়নামতির প্রাসাদ অষ্টম থেকে দ্বাদশ শতকের মধ্যে নির্মিত হয় এবং এটি চন্দ্র রাজবংশের রাজা মানিক চন্দ্রের রাণী ময়নামতির নামে প্রতিষ্ঠিত। ঐতিহাসিক তথ্য অনুযায়ী, চন্দ্র রাজবংশের শেষ পরিচিত রাজা গোবিন্দ চন্দ্রের মা ছিলেন রাণী ময়নামতি। পরবর্তীকালে এই এলাকার নামও রাণীর নামানুসারে ‘ময়নামতি’ রাখা হয়।
প্রত্নতত্ত্ববিদদের মতে, এই প্রাসাদ কেবল রাজবাড়ি নয়, বরং এটি প্রাচীন সমতট রাজ্যের রাজধানী দেবপর্বতের একটি ধর্মীয় বা প্রশাসনিক কেন্দ্র ছিল। বহু প্রত্নবস্তু বিশ্লেষণে ধারণা করা হয়, এটি একটি বৌদ্ধ বিহার বা মন্দির ছিল। ময়নামতি অঞ্চলে এখন পর্যন্ত প্রায় ৫০টিরও বেশি বৌদ্ধ প্রত্নস্থলের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে, যা প্রাচীন বাংলার ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক বিকাশের গুরুত্বপূর্ণ প্রমাণ বহন করে।
প্রথমবার ১৯৮৮ সালে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের উদ্যোগে এই স্থানে খননকাজ শুরু হয়। তখন আবিষ্কৃত হয় চারটি পৃথক নির্মাণ যুগের স্থাপত্য কাঠামো। এসব কাঠামো ও প্রত্নবস্তু বিশ্লেষণে প্রত্নতত্ত্ববিদরা স্থাপনাটিকে অষ্টম থেকে দ্বাদশ শতকের বলে চিহ্নিত করেছেন।
খননকালে পাওয়া প্রত্নবস্তুগুলোর মধ্যে ছিল প্রাগৈতিহাসিক যুগের পাথরের হাতিয়ার, জীবাশ্ম কাঠ, লোহার কাস্তে, কলস, হাঁড়ি, পানির পাত্র, কালির দোয়াত, ঘর নির্মাণসামগ্রী, পেরেক, শাবল এবং পোড়া ইটের নিদর্শন। ২০১৬ সালে তৃতীয় দফায় খননকাজ পরিচালিত হলেও, পরবর্তীতে তা বন্ধ হয়ে যায়।
বর্তমানে প্রাসাদটি প্রায় ১০ একর জমির ওপর বিস্তৃত, যার উচ্চতা সমতল থেকে প্রায় ১৫ দশমিক ২৪ মিটার। চারপাশে প্রায় ১৫৫ মিটার দৈর্ঘ্য ও ১৫২ মিটার প্রস্থের একটি বেষ্টনী প্রাচীরের ধ্বংসাবশেষ পাওয়া গেছে, যা এটি একটি দুর্গনির্মিত সুরক্ষিত কেন্দ্র ছিল বলে ধারণা দেয়।
সরেজমিনে দেখা গেছে, প্রাসাদের প্রধান ফটকসহ বিভিন্ন স্থাপত্যাংশ ভাঙাচোরা অবস্থায় পড়ে আছে। পশ্চিম পাশের সীমানা প্রাচীরের পাশে স্থানীয় বখাটেদের আড্ডা এবং অযত্নে ঝোপঝাড়ে ঢাকা পড়ে গেছে বহু অংশ। প্রাচীন পোড়া ইটের গাঁথুনি, ক্ষয়িষ্ণু পরিখা ও গর্তগুলো এখনো হাজার বছরের ইতিহাসের সাক্ষ্য বহন করছে, তবে সরকারি তত্ত্বাবধানের অভাবে দ্রুত নষ্ট হয়ে যাচ্ছে এই ঐতিহ্যবাহী নিদর্শন।
স্থানীয় বাসিন্দাদের মতে, পর্যাপ্ত সংরক্ষণ ব্যবস্থা নিলে রাণী ময়নামতির প্রাসাদ একটি সম্ভাবনাময় পর্যটনকেন্দ্রে পরিণত হতে পারে। ইতিহাস ও স্থাপত্যপ্রেমী দর্শনার্থীদের কাছে এটি আকর্ষণীয় গন্তব্য হিসেবে গড়ে ওঠার সম্ভাবনা রয়েছে।
স্থানীয় শিক্ষক ও নাগরিকরা মনে করেন, প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর এবং স্থানীয় প্রশাসন সমন্বিতভাবে উদ্যোগ নিলে প্রাসাদটি পর্যটনসম্পদ হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে। এতে সরকারি রাজস্ব বৃদ্ধি এবং স্থানীয় অর্থনীতি উভয়ই উপকৃত হবে।
কুমিল্লা কমার্স কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক হুমায়ুন কবির মাসউদ বলেন, “প্রাচীন সমতট অঞ্চলের এই প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনটি ইতিহাসচর্চার অমূল্য উপাদান। এটিকে রক্ষায় সরকারকে আরও কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে।”
প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের সিলেট, চট্টগ্রাম ও কুমিল্লা বিভাগের আঞ্চলিক পরিচালক ড. মোছা. নাহিদ সুলতানা জানিয়েছেন, প্রাসাদের জমির পরিমাণ নির্ধারণ এবং সীমানা প্রাচীর নির্মাণের প্রস্তাবনা প্রধান কার্যালয়ে পাঠানো হয়েছে। তবে বর্তমানে প্রধান কার্যালয়ের নির্দেশনা অনুযায়ী সব ধরনের নির্মাণকাজ স্থগিত রয়েছে। পর্যাপ্ত বরাদ্দ পাওয়া গেলে রাণী ময়নামতির প্রাসাদকে পর্যটনকেন্দ্র হিসেবে উন্নয়ন করার পরিকল্পনা রয়েছে বলে তিনি জানান।
রাণী ময়নামতির প্রাসাদ শুধু একটি প্রত্নস্থল নয়, এটি প্রাচীন বঙ্গের রাজনৈতিক, ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। সংরক্ষণ ও গবেষণার মাধ্যমে এই নিদর্শন বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী স্থাপত্য ইতিহাসে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করতে পারে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, প্রয়োজনীয় সরকারি তদারকি ও সংরক্ষণ কার্যক্রম শুরু হলে এটি শুধু দেশের নয়, আন্তর্জাতিক পর্যটনেরও অন্যতম আকর্ষণীয় গন্তব্য হতে পারে।


