যুদ্ধবিরতির পরও গাজায় দুর্ভোগ অব্যাহত, মানবিক বিপর্যয়ে পড়েছে লাখো ফিলিস্তিনি

যুদ্ধবিরতির পরও গাজায় দুর্ভোগ অব্যাহত, মানবিক বিপর্যয়ে পড়েছে লাখো ফিলিস্তিনি

আন্তর্জাতিক ডেস্ক

ঢাকা, ৩ নভেম্বর ২০২৫: যুদ্ধবিরতি কার্যকর থাকলেও গাজা উপত্যকায় ফিলিস্তিনিদের মানবিক দুর্ভোগ কমেনি। ইসরায়েলি অবরোধে খাদ্য সংকট, চিকিৎসার অভাব, ঠান্ডা ও নিরাপত্তাহীনতায় বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে লাখো মানুষ। স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর মতে, গাজা এখন এক গভীর মানবিক সংকটের মুখে।

সোমবার প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে আল জাজিরা জানিয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় যুদ্ধবিরতি ঘোষণার পরও ইসরায়েলি বাহিনীর হামলা অব্যাহত রয়েছে। ফিলিস্তিনের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, গত এক মাসে অন্তত ২৩৬ জন ফিলিস্তিনি নিহত এবং ৬০০ জনের বেশি আহত হয়েছেন। শুধু গত ২৪ ঘণ্টায় তিনজনের মৃত্যু এবং ধসে পড়া ভবন থেকে আরও তিনজনের মরদেহ উদ্ধারের খবর দিয়েছে স্থানীয় হাসপাতালগুলো।

গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, যুদ্ধবিরতি শুরুর পর থেকে ধ্বংসস্তূপের নিচ থেকে অন্তত ৫০০ ফিলিস্তিনির মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। নিহতদের অধিকাংশই ইসরায়েলের দীর্ঘদিনের বোমাবর্ষণ ও অবরোধের শিকার।

অন্যদিকে, রোববার সন্ধ্যায় ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর জানায়, রেডক্রসের মাধ্যমে তিনজন ইসরায়েলি বন্দির মরদেহ ফেরত আনা হয়েছে। যুদ্ধবিরতির শর্ত অনুযায়ী, প্রতিটি ইসরায়েলি বন্দির মরদেহের বিনিময়ে ইসরায়েলকে ১৫ জন ফিলিস্তিনি বন্দির মরদেহ ফেরত দিতে হবে।

এদিকে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক বাহিনীর সেন্ট্রাল কমান্ড (সেন্টকম) অভিযোগ করেছে, হামাস দক্ষিণ গাজার খান ইউনিস এলাকায় একটি ত্রাণবাহী ট্রাক লুট করেছে। তবে এই অভিযোগের কোনো প্রমাণ উপস্থাপন করা হয়নি। একটি ড্রোন ফুটেজের বরাত দিয়ে দাবি করা হয়, হামাস সদস্যরা মানবিক সহায়তা নিজেদের দখলে নিয়েছে।

গাজার সরকারি গণমাধ্যম কার্যালয় এই অভিযোগ অস্বীকার করে জানিয়েছে, এটি সম্পূর্ণ মিথ্যা ও পরিকল্পিত প্রচারণা। বিবৃতিতে বলা হয়, “ইসরায়েল ইচ্ছাকৃতভাবে মানবিক সহায়তা সরবরাহে বাধা দিচ্ছে, যাতে ক্ষুধা ও অনাহার সৃষ্টি করে গাজায় মানবিক বিপর্যয় ঘটানো যায়।”

অবরোধের কারণে গাজার হাসপাতালগুলো তীব্র সংকটে পড়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) হিসাব অনুযায়ী, বিশেষায়িত চিকিৎসার প্রয়োজন এমন প্রায় ১৬ হাজার ৫০০ জন রোগী এখনো গাজায় চিকিৎসাহীন অবস্থায় রয়েছেন। সীমান্ত খুলে না দেওয়ায় তাদের বিদেশে নেওয়া সম্ভব হচ্ছে না।

জাতিসংঘের সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সেপ্টেম্বর পর্যন্ত মিসর প্রায় ৪ হাজার আহত ফিলিস্তিনিকে চিকিৎসার জন্য গ্রহণ করেছে। সংযুক্ত আরব আমিরাত নিয়েছে ১ হাজার ৪৫০ জন, কাতার ৯৭০ জন, তুরস্ক ৪৩৭ জন এবং ইউরোপে সবচেয়ে বেশি চিকিৎসা দিয়েছে ইতালি—২০১ জনকে। তবে এখনো প্রায় ৩ হাজার ৮০০ শিশুসহ হাজারো মানুষ চিকিৎসার অপেক্ষায় রয়েছেন।

এদিকে শীত ঘনিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে গাজার বাস্তুচ্যুত মানুষদের দুর্ভোগ আরও বাড়ছে। নির্মাণসামগ্রী প্রবেশে ইসরায়েলের নিষেধাজ্ঞার কারণে অনেকেই ধ্বংসস্তূপের ইট ও কাদামাটি দিয়ে অস্থায়ী ঘর তৈরি করছেন।

গাজা সিটির ৪২ বছর বয়সী বাসিন্দা খালেদ আল-দাহদুহ বলেন, “শীত আসছে, তাই কাদা ও ধ্বংসস্তূপের ইট দিয়ে একটি অস্থায়ী আশ্রয় বানিয়েছি। এতে অন্তত ঠান্ডা ও বৃষ্টির হাত থেকে কিছুটা রক্ষা পাওয়া যায়।” তার আত্মীয় সাইফ আল-বায়েক জানান, “পুরো এলাকা ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। যতটুকু পাথর পেয়েছি, তা দিয়েই কাদার দেয়াল তুলেছি। কিন্তু ছাদে ফাঁক থাকায় পানি ঢুকে ঘর টিকছে না।”

জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির (ইউএনডিপি) গাজা প্রতিনিধি আলেসান্দ্রো ম্রাকিচ বলেন, “নির্মাণসামগ্রী না থাকায় মানুষ প্রাচীন পদ্ধতিতে ঘর তৈরি করছে। এটি তাদের বেঁচে থাকার একমাত্র উপায় হয়ে দাঁড়িয়েছে।”

সহায়তা সংস্থাগুলো সতর্ক করেছে, শীতকালে তাপমাত্রা আরও কমে গেলে পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করবে। যুদ্ধবিরতি কার্যকর হলেও ক্ষুধা, ঠান্ডা, চিকিৎসাহীনতা ও অনিশ্চয়তায় গাজার লাখো মানুষ এখনো মৃত্যুভয়ে দিন কাটাচ্ছেন।

আন্তর্জাতিক