অর্থনীতি ডেস্ক
বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতে বছরের পর বছর বিপুল পরিমাণ খেলাপি ঋণের তথ্য গোপন রাখার অভিযোগ তদন্তে নামছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)। সংস্থাটি জানতে চায়, এই গোপনীয়তার পেছনে পরিকল্পিত কোনো কারচুপি ছিল কিনা, নাকি ব্যাংক পরিদর্শনে চরম অবহেলা ঘটেছে।
আজ মঙ্গলবার বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে আইএমএফ প্রতিনিধি দলের বৈঠকে এ বিষয়ে বিস্তারিত ব্যাখ্যা চাওয়া হয়। বৈঠকে আইএমএফ প্রতিনিধিরা জানতে চান, খেলাপি ঋণের প্রকৃত তথ্য কীভাবে ও কেন বছরের পর বছর জনসমক্ষে প্রকাশ করা হয়নি এবং ব্যাংক পরিদর্শনের সময় তা কীভাবে অদেখা থেকে গেছে। বৈঠকে উপস্থিত একাধিক কর্মকর্তা এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
বৈঠকে আলোচনার সময় আইএমএফ স্পষ্টভাবে উল্লেখ করে, ব্যাংকিং খাতের প্রকৃত চিত্র গোপন রেখে আর্থিক খাতের স্থিতিশীলতা নিয়ে বিভ্রান্তিকর বার্তা দেওয়া হয়েছে কি না, তা এখন তাদের তদন্তের মূল বিষয়। সংস্থাটি জানতে চায়, গোপন রাখার এই প্রক্রিয়ার পেছনে সরকারি বা বেসরকারি ব্যাংকের কর্মকর্তা কিংবা কোনো নীতিনির্ধারক পর্যায়ের ভূমিকা ছিল কি না।
গত কয়েক বছর ধরে ব্যাংকিং খাতের প্রকৃত অবস্থা আড়াল রেখে একে “সুস্থ ও স্থিতিশীল” হিসেবে উপস্থাপনের চেষ্টা চলছিল বলে অভিযোগ রয়েছে। সরকার পরিবর্তনের পর এই গোপনীয়তার পর্দা সরে যেতে শুরু করেছে। ফলে সাম্প্রতিক সময়ে প্রকাশিত তথ্যে দেখা যাচ্ছে, খেলাপি ঋণের পরিমাণ হঠাৎ করেই বিপুল হারে বেড়ে গেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ হিসাবে দেখা যায়, এক বছরের ব্যবধানে দেশের মোট খেলাপি ঋণ প্রায় চার লাখ কোটি টাকা থেকে বেড়ে সাড়ে ছয় লাখ কোটি টাকায় পৌঁছেছে। সরকারি ব্যাংকগুলোতে এই হার উদ্বেগজনকভাবে বেড়ে ৪০ শতাংশ ছাড়িয়েছে, যেখানে বেসরকারি ব্যাংকগুলোতেও খেলাপি ঋণের হার ১০ শতাংশের ওপরে।
আইএমএফের ঋণ কর্মসূচির আওতায় বাংলাদেশের জন্য নির্ধারিত অন্যতম প্রধান শর্ত হলো, ২০২৬ সালের মধ্যে সরকারি ব্যাংকের খেলাপি ঋণের হার ১০ শতাংশের নিচে নামিয়ে আনা। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতি বলছে, বাংলাদেশ এই লক্ষ্য থেকে অনেক দূরে অবস্থান করছে।
সংস্থাটি এখন খতিয়ে দেখছে, খেলাপি ঋণের পরিমাণ কম দেখানোর পেছনে ব্যাংক পরিদর্শন প্রক্রিয়ার দুর্বলতা বা ইচ্ছাকৃত কারচুপি কতটা ভূমিকা রেখেছে। বিশেষ করে পরিদর্শকরা দায়িত্ব পালনে গাফিলতি করেছেন কি না, কিংবা পরিদর্শন রিপোর্টে তথ্য গোপনের ঘটনা ঘটেছে কি না— সে বিষয়েও আইএমএফের বিশেষ নজর রয়েছে।
বিশ্লেষকদের মতে, এই তদন্তের ফলাফল বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাত ও সামগ্রিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার ওপর বড় ধরনের প্রভাব ফেলতে পারে। আইএমএফ যদি গোপনীয়তা বা কারচুপির প্রমাণ পায়, তাহলে ভবিষ্যতে ঋণ কর্মসূচির শর্ত আরও কঠোর হতে পারে। পাশাপাশি ব্যাংক পরিদর্শন নীতিমালায় বড় ধরনের পরিবর্তনও আসতে পারে।
অর্থনৈতিক বিশেষজ্ঞদের ধারণা, প্রকৃত খেলাপি ঋণের তথ্য প্রকাশ পাওয়ার পর সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংককে নতুন করে খাতটিকে স্থিতিশীল করতে ব্যাপক সংস্কারে যেতে হতে পারে। আইএমএফের চলমান তদন্ত সেই সংস্কার প্রক্রিয়াকে আরও ত্বরান্বিত করতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে।


