আন্তর্জাতিক ডেস্ক
ওয়াশিংটন, ৫ নভেম্বর: আমদানি পণ্যের ওপর ব্যাপক হারে শুল্ক আরোপের বৈধতা নিয়ে এক মামলায় বুধবার সুপ্রিম কোর্টে তীব্র সমালোচনার মুখে পড়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। মামলাটি যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের ক্ষমতার পরিধি, আন্তর্জাতিক বাণিজ্য সম্পর্ক এবং বৈশ্বিক অর্থনীতির ওপর গভীর প্রভাব ফেলতে পারে বলে পর্যবেক্ষণ করেছেন বিশ্লেষকেরা।
নয়জন বিচারপতির মধ্যে ছয়জন রক্ষণশীল হলেও, তাদের বেশ কয়েকজনও হোয়াইট হাউজের শুল্ক আরোপের যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের দাবি, যুক্তরাষ্ট্রের উৎপাদন খাত পুনরুজ্জীবিত করা ও বাণিজ্য ঘাটতি কমাতে এই শুল্ক অপরিহার্য। কিন্তু মামলার বাদীপক্ষের মতে, এই পদক্ষেপ প্রেসিডেন্টের সাংবিধানিক ক্ষমতার সীমা অতিক্রম করেছে এবং কার্যত কর আরোপের সমতুল্য।
বিচারপতি অ্যামি কনি ব্যারেট শুনানিতে প্রশ্ন তোলেন, “তাহলে কি প্রতিটি দেশকেই প্রতিরক্ষা ও শিল্পের জন্য হুমকি বিবেচনা করে শুল্ক আরোপ করতে হয়েছে—স্পেন বা ফ্রান্সও?” তিনি বলেন, কিছু দেশের ক্ষেত্রে যুক্তি বোঝা গেলেও, বিশ্বব্যাপী এমন পদক্ষেপের কারণ স্পষ্ট নয়।
প্রধান বিচারপতি জন রবার্টস উল্লেখ করেন, যদি প্রশাসনের যুক্তি গ্রহণ করা হয়, তবে ভবিষ্যতে প্রেসিডেন্ট যেকোনো দেশ ও যেকোনো পণ্যের ওপর অনির্দিষ্ট সময়ের জন্য শুল্ক আরোপ করতে পারবেন, যা এককভাবে অতিরিক্ত ক্ষমতা প্রদান বলে বিবেচিত হতে পারে।
রক্ষণশীল বিচারপতি নিল গোরসাচ বলেন, “এই যুক্তি মেনে নিলে কংগ্রেসের বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা কার্যত বিলুপ্ত হয়ে যাবে। প্রেসিডেন্ট তখন জলবায়ু পরিবর্তনের অজুহাতে গাড়ি বা যন্ত্রাংশ আমদানিতেও ৫০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করতে পারেন।”
অন্যদিকে বিচারপতি সোনিয়া সোটোমেয়র মন্তব্য করেন, “আপনি বলছেন শুল্ক কর নয়, কিন্তু বাস্তবে এটি করের মতোই কাজ করছে।”
মামলাটি ১৯৭৭ সালের ইন্টারন্যাশনাল ইমার্জেন্সি ইকোনমিক পাওয়ার্স অ্যাক্ট (IEEPA)-এর আওতায় দায়ের করা হয়েছে। আইনটি জরুরি পরিস্থিতিতে প্রেসিডেন্টকে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা দেয়।
ট্রাম্প ২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে চীন, মেক্সিকো ও কানাডা থেকে আসা পণ্যের ওপর প্রথমবার এই আইন ব্যবহার করে শুল্ক আরোপ করেন। তার দাবি ছিল, এসব দেশ থেকে পাচার হয়ে আসা মাদক যুক্তরাষ্ট্রের জন্য ‘জরুরি অবস্থা’ সৃষ্টি করছে। পরে এপ্রিল মাসে তিনি এই ক্ষমতা ব্যবহার করে বিশ্বের প্রায় সব দেশের পণ্যের ওপর ১০ থেকে ৫০ শতাংশ পর্যন্ত শুল্ক আরোপের নির্দেশ দেন, বাণিজ্য ঘাটতিকে ‘অস্বাভাবিক হুমকি’ হিসেবে উল্লেখ করে।
প্রশাসনের পক্ষে সলিসিটর জেনারেল জন সাউয়ার যুক্তি দেন, প্রেসিডেন্টের শুল্ক আরোপের ক্ষমতা আইইইপিএ আইনের অধীনে বৈধ এবং এটি বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণের স্বাভাবিক সম্প্রসারণ। তিনি সতর্ক করে বলেন, আদালত যদি ট্রাম্পের ক্ষমতা অবৈধ ঘোষণা করে, তবে যুক্তরাষ্ট্র ‘নিষ্ঠুর বাণিজ্য প্রতিশোধের’ মুখে পড়বে, যা অর্থনৈতিক ও জাতীয় নিরাপত্তার জন্য ক্ষতিকর হবে।
বেসরকারি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও কয়েকটি অঙ্গরাজ্যের পক্ষ থেকে যুক্তি দেওয়া হয়, আইইইপিএ আইনে কোথাও “শুল্ক” শব্দটির উল্লেখ নেই। তাদের দাবি, কংগ্রেস কখনোই প্রেসিডেন্টকে এমন অসীম ক্ষমতা দিতে চায়নি যা বিদ্যমান বাণিজ্য চুক্তি বাতিল বা রাজস্ব আদায়ের সুযোগ তৈরি করে।
আইনজীবী নিল কাটিয়াল বলেন, “এই আইন প্রেসিডেন্টকে নিষেধাজ্ঞা বা কোটা আরোপের ক্ষমতা দেয়, রাজস্ব আদায়ের উদ্দেশ্যে কর বা শুল্ক আরোপের নয়।”
ওয়েলস ফার্গোর বিশ্লেষকদের হিসাব অনুযায়ী, মামলাটি প্রায় ৯০ বিলিয়ন ডলারের আমদানি শুল্কের ওপর প্রভাব ফেলতে পারে—যা চলতি বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের মোট শুল্ক আয়ের প্রায় অর্ধেক। আদালত যদি রায় দিতে দেরি করে, এই অঙ্ক এক ট্রিলিয়ন ডলারে পৌঁছাতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
বুধবারের শুনানি প্রায় তিন ঘণ্টা ধরে চলে, যা বিচারপতিদের নির্ধারিত সময়ের চেয়ে অনেক বেশি। আদালত যদি ট্রাম্পের পক্ষে রায় দেয়, তবে তা নিম্ন আদালতের পূর্ববর্তী তিনটি রায় বাতিল করবে এবং প্রেসিডেন্টের নির্বাহী ক্ষমতার পরিধি আরও বাড়িয়ে দেবে।
আদালতের বাইরে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা মামলার অগ্রগতি ঘনিষ্ঠভাবে পর্যবেক্ষণ করছিলেন। যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা সারাহ ওয়েলস জানান, তার কোম্পানি বিদেশ থেকে আমদানি করা উপকরণের ওপর অতিরিক্ত শুল্কের কারণে প্রায় ২০ হাজার ডলার ক্ষতির মুখে পড়েছে। ফলে তাদের সরবরাহ চেইন ভেঙে পড়েছে এবং কিছু কর্মীকে ছাঁটাই করতে হয়েছে।
ওয়েলস বলেন, “আমার মনে হয়েছে আদালত বুঝতে পারছে প্রেসিডেন্ট যে পরিমাণ ক্ষমতা ব্যবহার করেছেন তা সীমা অতিক্রম করেছে। আশা করি, বিচারপতিরা এই ক্ষমতার লাগাম টানার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করবেন।”
সুপ্রিম কোর্ট এখন এই মামলার রায় বিবেচনা করছে, যা যুক্তরাষ্ট্রের প্রশাসনিক ক্ষমতার সীমা ও আন্তর্জাতিক বাণিজ্য নীতিতে দীর্ঘমেয়াদি দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারে।


