আন্তর্জাতিক ডেস্ক
তৃতীয় দফায় অনুষ্ঠিত পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের শান্তি সংলাপ কোনো চুক্তি বা লিখিত সমঝোতা ছাড়াই শেষ হয়েছে। তুরস্কের ইস্তাম্বুলে আয়োজিত এই বৈঠক অচলাবস্থায় পড়ায় দুই দেশের মধ্যকার সম্পর্ক পুনরায় উত্তেজনার মুখে পড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
পাকিস্তানের প্রতিরক্ষামন্ত্রী খাজা মুহাম্মদ আসিফ দেশটির সংবাদমাধ্যম জিও নিউজ-কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছেন, সংলাপ কোনো অগ্রগতি ছাড়াই শেষ হয়েছে। তিনি বলেন, “একটি পূর্ণাঙ্গ অচলাবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। আমাদের আলোচনার কোনো ভবিষ্যৎ নেই।”
গত বৃহস্পতিবার ইস্তাম্বুলে অনুষ্ঠিত এই বৈঠকে পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের সরকারি প্রতিনিধিরা অংশ নেন। কাতার ও তুরস্কের মধ্যস্থতায় আয়োজিত এ সংলাপের লক্ষ্য ছিল দুই দেশের মধ্যে একটি শান্তি চুক্তিতে উপনীত হওয়া। কিন্তু আলোচনার শেষ পর্যায়ে আফগান প্রতিনিধি দল চুক্তি স্বাক্ষর থেকে বিরত থাকায় সংলাপ ব্যর্থ হয়।
খাজা আসিফ বলেন, “আমরা সন্ত্রাসবাদ দমনে আফগানিস্তানের সহযোগিতা চেয়েছিলাম, এবং কাতার ও তুরস্ক আমাদের অবস্থানকে সমর্থন করেছে। এমনকি আফগান প্রতিনিধিরাও মৌখিকভাবে আমাদের সঙ্গে একমত হয়েছিলেন। কিন্তু যখন লিখিত চুক্তি স্বাক্ষরের প্রসঙ্গ আসে, তখন তারা পিছু হটে যান। কোনো আন্তর্জাতিক আলোচনা কীভাবে লিখিত সমঝোতা ছাড়া হতে পারে?”
২০২১ সালে আফগানিস্তানে তালেবান সরকারের প্রতিষ্ঠার পর থেকে ইসলামাবাদ ও কাবুলের মধ্যে সম্পর্ক ক্রমশ তিক্ত হয়ে উঠেছে। একসময়ের ঘনিষ্ঠ মিত্র এই দুই দেশের মধ্যে এখন অবিশ্বাস ও উত্তেজনা প্রবল। মূলত পাকিস্তানভিত্তিক সশস্ত্র গোষ্ঠী তেহরিক-ই তালেবান পাকিস্তান (টিটিপি)-কে কেন্দ্র করেই এই দ্বন্দ্বের সূত্রপাত।
কট্টর ইসলামপন্থি টিটিপির হামলায় গত কয়েক বছরে পাকিস্তানে হাজারো সামরিক ও বেসামরিক মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন। গোষ্ঠীটিকে বহু বছর আগে নিষিদ্ধ ঘোষণা করলেও তাদের কার্যক্রম থেমে নেই। বরং তালেবান সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে টিটিপির তৎপরতা আরও বেড়েছে বলে অভিযোগ ইসলামাবাদের।
পাকিস্তানের অভিযোগ, আফগানিস্তানের তালেবান সরকার টিটিপিকে আশ্রয় ও সহযোগিতা দিচ্ছে। তবে কাবুল সরকার এই অভিযোগ অস্বীকার করে আসছে।
চলতি মাসের শুরুতে পাকিস্তান টিটিপির বিরুদ্ধে আফগান রাজধানী কাবুলে বিমান অভিযান চালায়। ওই অভিযানে নিহত হন গোষ্ঠীটির শীর্ষ নেতা নূর ওয়ালি মেহসুদ এবং দ্বিতীয় নেতা ক্বারি সাইফুল্লাহ মেহসুদসহ কয়েকজন উচ্চপদস্থ সদস্য। এর প্রতিক্রিয়ায় ১১ অক্টোবর আফগান সেনাবাহিনী খাইবার পাখতুনখোয়ার সীমান্তবর্তী পাকিস্তানি চৌকিগুলোতে হামলা চালায়। পরবর্তী তিন দিনে দুই পক্ষের সংঘাতে আফগান সেনাবাহিনীর প্রায় দুই শতাধিক এবং পাকিস্তানি সেনার ২৩ জন সদস্য নিহত হন বলে জানায় পাকিস্তানের আন্তঃবিভাগ সংযোগ দপ্তর (আইএসপিআর)।
এই সংঘাতের পর ১৫ অক্টোবর দুই দেশ ৪৮ ঘণ্টার যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয়। ওই সময় কাতারের দোহায় প্রথম দফা শান্তি আলোচনা হয়, পরে ২৫ অক্টোবর তা স্থানান্তরিত হয় তুরস্কের ইস্তাম্বুলে।
ইস্তাম্বুল সংলাপে অংশ নেওয়া মধ্যস্থতাকারী দুই দেশ—কাতার ও তুরস্ক—ও হতাশা প্রকাশ করেছে বলে জানিয়েছেন খাজা আসিফ। তিনি বলেন, “তাদের যদি সামান্য আশাও থাকত, তবে আমাদের সংলাপ চালিয়ে যেতে বলতেন। কাবুলের অবস্থান তাদেরও নিরাশ করেছে।”
পাকিস্তানের প্রতিরক্ষামন্ত্রী আরও বলেন, “আমাদের একমাত্র শর্ত ছিল—আফগানিস্তানের ভূখণ্ড যেন পাকিস্তানে হামলার জন্য ব্যবহার না হয়। কিন্তু কাবুল সে প্রতিশ্রুতি দিতে পারেনি। ভবিষ্যতে যদি আফগান ভূখণ্ড থেকে পাকিস্তানে কোনো হামলা হয়, আমরা তার জবাব দিতে বাধ্য হব।”
এই ব্যর্থ সংলাপের ফলে পাকিস্তান-আফগানিস্তান সম্পর্কের উত্তেজনা আরও বৃদ্ধি পাওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। কূটনৈতিক পর্যবেক্ষকরা বলছেন, দুই দেশের মধ্যে পারস্পরিক আস্থা পুনর্গঠনের উদ্যোগ না নেওয়া হলে সীমান্ত এলাকায় সংঘাতের ঝুঁকি আরও বাড়বে।


