ঢাকা-১৪ আসনে ‘ভাই-বোনের’ ভোটযুদ্ধ: গুমের শিকার দুই পরিবারের প্রতিনিধি মুখোমুখি

ঢাকা-১৪ আসনে ‘ভাই-বোনের’ ভোটযুদ্ধ: গুমের শিকার দুই পরিবারের প্রতিনিধি মুখোমুখি

রাজনীতি ডেস্ক

রাজধানীর উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের গুরুত্বপূর্ণ এলাকা ঢাকা-১৪ আসনে আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে একটি ব্যতিক্রমী প্রতিদ্বন্দ্বিতা দেখা যাচ্ছে। গুমের শিকার এক ব্যক্তি ও গুম হওয়া এক নেতার বোন—এই দুইজনই এখন প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী। একজন জামায়াতে ইসলামীর মনোনীত, অন্যজন বিএনপির। নির্বাচনি মাঠে তারা একে অপরকে সম্বোধন করছেন ‘ভাই’ ও ‘বোন’ হিসেবে, যা এ আসনের ভোটযুদ্ধকে করেছে মানবিক ও প্রতীকীভাবে ব্যতিক্রমী।

ঢাকা-১৪ আসনটি দারুস সালাম, শাহ আলী ও মিরপুর থানার আংশিক এলাকা এবং সাভারের কাউন্দিয়া ও বনগাঁও ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত। প্রায় সাড়ে চার লাখ ভোটারের এ আসনে নির্বাচনের প্রস্তুতি চলছে বেশ জমজমাটভাবে। জামায়াতে ইসলামীর প্রার্থী ব্যারিস্টার মীর আহমদ বিন কাসেম (আরমান) ও বিএনপির প্রার্থী সানজিদা ইসলাম তুলি—দুজনই নির্বাচনী প্রচারণায় সক্রিয়ভাবে মাঠে রয়েছেন।

ব্যারিস্টার আরমান একসময় গুমের শিকার হয়েছিলেন। ২০১৬ সালে তিনি নিখোঁজ হন এবং প্রায় আট বছর পর ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট ফিরে আসেন। পরে জামায়াতে ইসলামীর আমিরের আহ্বানে তিনি ঢাকা-১৪ আসনে প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন গ্রহণ করেন। তার বাবা মীর কাসেম আলী ছিলেন জামায়াতে ইসলামীর নির্বাহী পরিষদ সদস্য ও ইসলামী ছাত্রশিবিরের সাবেক সভাপতি, যিনি একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত হন।

আরমান বর্তমানে নির্বাচনি প্রচারণায় অংশ নিচ্ছেন খোলা হুডের গাড়িতে করে। তার প্রচারণায় মোটরসাইকেল শোভাযাত্রা, ব্যানার ও পোস্টারে ভরপুর হয়েছে কাউন্দিয়া ও বনগাঁওসহ মিরপুরের বিভিন্ন এলাকা। জনগণের সঙ্গে সাক্ষাতে তিনি এলাকার সমস্যাগুলো তুলে ধরছেন এবং সমাধানের প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন। তিনি বলেন, “এই অঞ্চলের মূল সমস্যা মাদক। তরুণ সমাজকে মাদকের হাত থেকে রক্ষা করতে আমরা সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলব। পাশাপাশি যোগাযোগব্যবস্থা, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবার উন্নয়নে কাজ করব।”

বিএনপির মনোনীত প্রার্থী সানজিদা ইসলাম তুলি গুম হওয়া বিএনপি নেতা সুমনের বোন। তিনি দীর্ঘদিন ধরে গুম হওয়া ব্যক্তিদের পরিবারের পক্ষে কাজ করে আসছেন। সম্প্রতি বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের উপদেষ্টা মাহদি আমিনের উপস্থিতিতে তিনি প্রচারণা শুরু করেন। দলীয় নেতাকর্মীদের সঙ্গে মতবিনিময় সভা, লিফলেট বিতরণ ও শোভাযাত্রার মধ্য দিয়ে তিনি ভোটারদের কাছে নিজেকে তুলে ধরছেন।

প্রচারণাকালে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তুলি বলেন, “১২ বছর আন্দোলনের পর কিছু মানুষ ফিরে এসেছে, কিন্তু অনেকেই এখনো নিখোঁজ। আমি তাদের অধিকার আদায়ে মাঠে আছি। আরমান ভাই আমার সেই ভাই, যিনি একই অন্ধকার থেকে ফিরে এসেছেন। আমরা মানবিক ও গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ গঠনের জন্য একসঙ্গে লড়ছি।”

দুই প্রার্থীর মানবিক সম্পর্ক নির্বাচনি এলাকায় ইতিবাচক আলোচনার জন্ম দিয়েছে। অনেক ভোটার মনে করছেন, এ আসনে নির্বাচনের রাজনীতি নতুন দৃষ্টান্ত স্থাপন করবে। স্থানীয় বাসিন্দা মাহমুদ হাসান বলেন, “দুজনই গুমের সঙ্গে জড়িত পরিবারের মানুষ। তাদের পারস্পরিক শ্রদ্ধা আমাদের সমাজে সহনশীলতার বার্তা দিচ্ছে।”

অন্যদিকে কল্যাণপুরের বাসিন্দা মাইনুল হোসেন বলেন, “কে জিতবে জানি না, তবে প্রার্থীদের নির্বাচনে অংশগ্রহণই রাজনীতিতে নৈতিকতার নতুন ধারা তৈরি করছে।”

নির্বাচন কমিশনের ডিসেম্বর ২০২৩ সালের হিসাব অনুযায়ী, ঢাকা-১৪ আসনে মোট ভোটার ৪ লাখ ১৮ হাজার ২১৭ জন। এর মধ্যে পুরুষ ভোটার ২ লাখ ১৩ হাজার ৪৬৯, নারী ভোটার ২ লাখ ৪ হাজার ৭৪৪ এবং তৃতীয় লিঙ্গের ভোটার চারজন। আসনের রাজনৈতিক ইতিহাসে দেখা যায়, বিএনপি ও আওয়ামী লীগ পর্যায়ক্রমে এ আসনটি ধরে রেখেছে। নিকট অতীতে প্রয়াত এসএ খালেক বিএনপির এমপি ছিলেন, পরে আওয়ামী লীগের আসলামুল হক নির্বাচিত হন।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এই আসনের নির্বাচনটি মানবিক বার্তা ও অংশগ্রহণমূলক রাজনীতির একটি প্রতীকী উদাহরণ হয়ে উঠতে পারে। গুম ও নিখোঁজ ইস্যু বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতায় দীর্ঘদিন আলোচিত। এই দুই প্রার্থীর প্রতিদ্বন্দ্বিতা সেই আলোচনাকে নতুনভাবে সামনে এনেছে।

ঢাকা-১৪ আসনের ভোটযুদ্ধ তাই শুধু দুই রাজনৈতিক দলের প্রতিযোগিতা নয়; এটি এক মানবিক লড়াই, যেখানে গুমের শিকার পরিবারগুলোর যন্ত্রণার মধ্য থেকেও উঠে এসেছে গণতন্ত্র ও সহানুভূতির বার্তা

রাজনীতি শীর্ষ সংবাদ