জাতিসংঘের ভবিষ্যৎ: বিলুপ্ত হলে বিশ্বে কী প্রভাব পড়তে পারে

জাতিসংঘের ভবিষ্যৎ: বিলুপ্ত হলে বিশ্বে কী প্রভাব পড়তে পারে

আন্তর্জাতিক ডেস্ক:
প্রতিষ্ঠার ৮০ বছর পূর্ণ হওয়ার পরও জাতিসংঘের ভূমিকা ও কার্যকারিতা নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠছে। বিশেষ করে গাজা ও অন্যান্য সংকট এলাকায় সংস্থার কার্যকর পদক্ষেপের অভাব, পশ্চিমা বিশ্বের অগ্রাধিকার এবং আন্তর্জাতিক আইন প্রয়োগে সীমাবদ্ধতা নিয়ে সমালোচনা বৃদ্ধি পেয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যদি জাতিসংঘ বিলুপ্ত হয়, তবে বিশ্বে শরণার্থী, স্বাস্থ্য, মানবাধিকার ও শান্তি রক্ষার ক্ষেত্রে ব্যাপক প্রভাব পড়বে।

জাতিসংঘ ১৯৪৫ সালের অক্টোবর মাসে প্রতিষ্ঠিত হয়। আট দশকের বেশি সময় ধরে সংস্থাটি বৈশ্বিক স্বাস্থ্য, মানবাধিকার, শান্তি রক্ষা, কূটনীতি ও আন্তর্জাতিক আইনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। তবে সমালোচনার বিষয় হচ্ছে, সংস্থার নীতি প্রায়শই পশ্চিমা বিশ্বের স্বার্থকে অগ্রাধিকার দেয় এবং গ্লোবাল সাউথের প্রয়োজন তুলনায় পিছিয়ে থাকে। ১৯৯০-এর দশকে রুয়ান্ডা, বসনিয়া-হার্জেগোভিনা এবং সুদানের দারফুর অঞ্চলে গণহত্যা রোধে সংস্থা ব্যর্থ হওয়ার উদাহরণ রয়েছে।

বিশ্বব্যাপী অন্তত ১০ কোটি শরণার্থী ও বাস্তুচ্যুত মানুষের পরিস্থিতিতে জাতিসংঘের হাইকমিশনারস অফিসের ভূমিকা অপরিহার্য। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের রিফিউজি স্টাডিজ সেন্টারের জেফ ক্রিসপ বলেন, “জাতিসংঘ বিলুপ্ত হলে শরণার্থীদের জন্য সহায়তার শূন্যস্থান তৈরি হবে, যা শহুরে অঞ্চলে সামাজিক ও অর্থনৈতিক চাপ বৃদ্ধি করবে।” তিনি আরও বলেন, এর ফলে গ্লোবাল নর্থে অংশ কয়েকটি শরণার্থী কেন্দ্রীভূত হবে, তবে গ্লোবাল সাউথের বহু মানুষ ক্রমবর্ধমান ঝুঁকিতে পড়বে।

আন্তর্জাতিক আইনের ক্ষেত্রেও প্রভাব পড়বে। যুক্তরাজ্যের আইনজীবী জিওফ্রে নাইস উল্লেখ করেন, আন্তর্জাতিক আদালত যেমন আইসিজে ও আইসিসি কাজ চালিয়ে যেতে পারবে, তবে জাতিসংঘের অনুপস্থিতিতে রাষ্ট্র ও করপোরেশনগুলোর দায়বদ্ধতা বৃদ্ধি পাবে। তিনি বলেন, “জাতিসংঘ না থাকলে আন্তর্জাতিক আইন কার্যকর করার দায়িত্ব ক্রমবর্ধমানভাবে রাষ্ট্র, করপোরেশন ও সুশীল সমাজের ওপর চলে যাবে।”

শান্তি রক্ষায় সংস্থার গুরুত্ব নিয়েও সমালোচনা আছে। জাতিসংঘের সাবেক সহকারী মহাসচিব রমেশ ঠাকুর বলেন, একতরফা শান্তি রক্ষা আসলে বাস্তবিক শান্তি নয়, বরং ক্ষমতার প্রয়োগ। তিনি উল্লেখ করেন, সংস্থার বৈধতা এখনো গুরুত্বপূর্ণ, তবে নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্যদের (চীন, ফ্রান্স, রাশিয়া, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র) বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষমতা নেই।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) প্রেক্ষিতেও অনুরূপ শূন্যতা সৃষ্টি হবে। সাবেক প্রধান বিজ্ঞানী সৌম্য স্বামীনাথন বলেন, “ডব্লিউএইচওর অনুপস্থিতি বিশেষ করে নিম্ন আয়ের দেশগুলোকে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা, টিকা ও মহামারি মোকাবিলায় সহায়তা প্রদান বন্ধ করবে, যা জনজীবনের ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলবে।” তিনি উল্লেখ করেন, সংস্থার তত্ত্বাবধান ছাড়া বৈশ্বিক স্বাস্থ্য মান বজায় রাখা, মহামারি প্রতিরোধ এবং টিকার সমতা নিশ্চিত করা কঠিন হয়ে যাবে।

নর্থ ক্যারোলাইনা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জেমস টমাস বলেন, “জাতিসংঘ, ডব্লিউএইচও এবং ইউএসএআইডির মতো সংস্থা বৈশ্বিক কল্যাণমূলক কার্যক্রম পরিচালনা করে। সংস্থাগুলো না থাকলে, ছোট স্থানীয় সংস্থা শূন্যস্থান পূরণ করতে পারবে, তবে সেটি অনিশ্চিত ও খণ্ডিত হবে।” তিনি আরও বলেন, এই কাঠামো এখনও উপনিবেশিক উত্তরাধিকার বহন করছে এবং সহায়তাকে সম্পূর্ণভাবে ন্যায়সঙ্গত করা একটি চ্যালেঞ্জ।

বিশেষজ্ঞরা একমত, জাতিসংঘ বা অনুরূপ বিশ্বসংস্থা না থাকলে, রাষ্ট্রগুলো নিজেদের স্বার্থ অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নেবে এবং গ্লোবাল নর্থের প্রভাব বৃদ্ধি পাবে। শরণার্থী সুরক্ষা, আন্তর্জাতিক আইন কার্যকারিতা, শান্তি রক্ষা এবং বৈশ্বিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় শূন্যতা তৈরি হবে, যা মানুষের জীবন ও নিরাপত্তার ওপর দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব ফেলবে।

আন্তর্জাতিক