আইন-আদালত ডেস্ক
চব্বিশের জুলাই-আগস্টে সংঘটিত গণহত্যার দায়ে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল ও সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনের বিরুদ্ধে রায় ঘোষণা প্রক্রিয়া শুরু করেছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। সোমবার (১৭ নভেম্বর) দুপুর ১২টা ৪০ মিনিটে ট্রাইব্যুনালে ৪৫৩ পৃষ্ঠার রায়ের প্রথম অংশ পড়া শুরু হয়।
ট্রাইব্যুনাল-১–এর চেয়ারম্যান বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বে তিন সদস্যের বিচারিক প্যানেলে রয়েছেন বিচারপতি মো. শফিউল আলম মাহমুদ ও বিচারপতি মো. মোহিতুল হক এনাম চৌধুরী। রায় পাঠের দায়িত্ব পালন করছেন বিচারপতি এনাম চৌধুরী। মামলার অন্য দুই আসামি শেখ হাসিনা ও কামাল পলাতক থাকলেও চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন আটক অবস্থায় আদালতে উপস্থিত হন।
সকালে কারাগার থেকে কড়া নিরাপত্তায় প্রিজনভ্যানে করে তাকে ট্রাইব্যুনালে আনা হয়। হাজতখানায় নেওয়ার আগে কঠোর নিরাপত্তাব্যবস্থার মধ্যে সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য তাকে আদালত এলাকায় রাখা হয়। মামলায় রাজসাক্ষী হিসেবে সাক্ষ্য দেওয়ায় তার বিষয়ে শেষ পর্যন্ত কী সিদ্ধান্ত হবে, তা ট্রাইব্যুনালের ওপর ছেড়ে দিয়েছে প্রসিকিউশন। তবে অপর দুই আসামির সর্বোচ্চ সাজার দাবি জানানো হয়েছে।
মামলাকে ঘিরে ট্রাইব্যুনাল ও সুপ্রিম কোর্ট এলাকায় নিরাপত্তা জোরদার করা হয়। পুলিশ, র্যাব, এপিবিএন, বিজিবি ও সেনাবাহিনীর যৌথ বাহিনী মোতায়েন করা হয়। গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরাও টহল ও নজরদারিতে অংশ নেন। রোববার (১৬ নভেম্বর) সন্ধ্যার পর থেকে দোয়েল চত্বর হয়ে শিক্ষাভবনমুখী সড়কে যান চলাচল সীমিত করা হয় এবং সাধারণ মানুষের প্রবেশ–চলাচলেও নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা হয়।
গত ১৩ নভেম্বর ট্রাইব্যুনাল আজকের দিনটিকে রায় ঘোষণার জন্য নির্ধারণ করে। তিন সদস্যের বিচারিক প্যানেল এ সিদ্ধান্ত দেয়। রায় ঘোষণার আগে মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ, জেরা এবং যুক্তিতর্কের পুরো প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়। মোট ২৮ কার্যদিবসে ৫৪ জন সাক্ষীর সাক্ষ্য ও জেরা শেষ করা হয়। প্রসিকিউশন ও রাষ্ট্রনিযুক্ত ডিফেন্সের যুক্তিতর্ক ও পাল্টা যুক্তিখণ্ডন চলে ৯ কার্যদিবস। ২৩ অক্টোবর রাষ্ট্রের প্রধান আইনকর্তা অ্যাটর্নি জেনারেলের সমাপনী বক্তব্যের পর রায়ের জন্য অপেক্ষার সময় নির্ধারণ করা হয়।
প্রসিকিউশন যুক্তিতর্কে অভিযোগ তোলে যে অভিযুক্তরা পরিকল্পনা, উসকানি, অস্ত্র ব্যবহারের নির্দেশনা ও প্রত্যক্ষ সহায়তার মাধ্যমে জুলাই-আগস্টে বিভিন্ন স্থানে সংঘটিত হত্যাকাণ্ড ও গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনে জড়িত ছিলেন। এ মামলায় মোট পাঁচটি অভিযোগ আনা হয়েছে— উসকানি, মারণাস্ত্র ব্যবহার, আবু সাঈদ হত্যা, চানখারপুলে হত্যা এবং আশুলিয়ায় লাশ পোড়ানোর ঘটনা।
মামলার অভিযোগের বিশদ বিবরণ ও প্রমাণাদির পরিমাণও উল্লেখযোগ্য। আনুষ্ঠানিক অভিযোগনামা ৮ হাজার ৭৪৭ পৃষ্ঠার, যেখানে তথ্যসূত্র রয়েছে ২ হাজার ১৮ পৃষ্ঠা, জব্দতালিকা ও দালিলিক প্রমাণ ৪ হাজার ৫ পৃষ্ঠা এবং শহীদদের তালিকার বিবরণ ২ হাজার ৭২৪ পৃষ্ঠা। তদন্ত সংস্থার প্রতিবেদন গত ১২ মে চিফ প্রসিকিউটরের কাছে জমা দেওয়া হয়। মোট ৮৪ জনকে সাক্ষী করা হয়েছিল, যদিও শেষ পর্যন্ত ৫৪ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ করা হয়।
রায় পড়া শুরুর পর আদালত অধিবেশনকক্ষে উপস্থিত আইনজীবী ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা নীরব পরিবেশে কার্যক্রম অনুসরণ করেন। দীর্ঘ বিচারপ্রক্রিয়ার পর ঘোষিত এই রায় দেশের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে বিশেষ গুরুত্ব বহন করছে। রায়ের পূর্ণাঙ্গ পাঠ শেষে আসামিদের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগের প্রমাণ, দায় নির্ধারণ এবং দণ্ডসংক্রান্ত সিদ্ধান্ত জানা যাবে।
মানবতাবিরোধী অপরাধের এই মামলার রায় বাংলাদেশের আইন ও বিচারব্যবস্থার সাম্প্রতিক ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হিসেবে বিবেচিত হবে বলে পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন। রায় ঘোষণার পর দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি, আইনশৃঙ্খলা ও প্রশাসনিক কাঠামোর ওপরও এর প্রভাব পড়তে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের পর আইনজীবী ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ পরবর্তী আইনি পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন।


