নিজস্ব প্রতিবেদক
নির্বাচনকালীন নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিলের পূর্ববর্তী রায় অবৈধ ঘোষণা করে সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী পুনর্বহালের ঐতিহাসিক রায় দিয়েছে আপিল বিভাগ। বৃহস্পতিবার সকাল ৯টা ৪০ মিনিটে প্রধান বিচারপতি ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদের নেতৃত্বে সাত সদস্যের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ সর্বসম্মত এ রায় ঘোষণা করেন, যা দেশের নির্বাচনী কাঠামো ও ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলবে।
রায় ঘোষণা উপলক্ষে আপিল বিভাগের এজলাস কক্ষে আইনজীবী, সংশ্লিষ্ট পক্ষের প্রতিনিধিসহ বিপুল সংখ্যক উপস্থিতি ছিল। সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা পুনর্বহালের ফলে রাষ্ট্রীয় নির্বাচন পরিচালনার পদ্ধতিতে দীর্ঘদিনের বিতর্ক ও আইনি জটিলতার একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ের অবসান ঘটল।
ঘোষিত রায়ে উল্লেখ করা হয়েছে, তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা স্বয়ংক্রিয়ভাবে সংবিধানে ফিরে এলেও আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে। চতুর্দশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন থেকে পুনর্বহালকৃত তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা কার্যকর হবে। প্রধান বিচারপতি এবং বেঞ্চের অন্য ছয় বিচারপতি একমত হয়ে এই সিদ্ধান্ত দেন।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত হয় ১৯৯৬ সালে ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে। ওই সংশোধনীর বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে ১৯৯৮ সালে কয়েকজন আইনজীবী হাইকোর্টে রিট করেন। হাইকোর্ট ২০০৪ সালের ৪ আগস্ট রিট খারিজ করে সংশোধনীকে বৈধ ঘোষণা করে। পরবর্তী সময়ে মামলাটি আপিল বিভাগে গড়ায়, এবং দীর্ঘ বিচারিক প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে ২০১১ সালের ১০ মে আপিল বিভাগ সংখ্যাগরিষ্ঠ মতামতের ভিত্তিতে ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল ঘোষণা করে।
ওই রায় ঘোষণার পর ২০১১ সালের ৩০ জুন জাতীয় সংসদে পাস হয় পঞ্চদশ সংশোধনী, যার মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বিলোপসহ কয়েকটি সাংবিধানিক পরিবর্তন কার্যকর হয়। এ বিষয়ে গেজেট প্রকাশিত হয় একই বছরের ৩ জুলাই। এসব প্রক্রিয়ার ফলে দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থাকে কেন্দ্র করে আইনি, রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিসরে ব্যাপক আলোচনা চলতে থাকে।
সাম্প্রতিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি, নির্বাচনকালীন সরকারের কাঠামো নিয়ে বিভিন্ন মহলের উদ্বেগ এবং বিভিন্ন পক্ষের আপিলের প্রেক্ষাপটে পুনর্বিবেচনার আবেদনগুলো আবারও গুরুত্ব পায়। ৫ আগস্ট সরকার পরিবর্তনের পর বেশ কয়েকজন বিশিষ্ট নাগরিক আপিল বিভাগের কাছে পূর্ববর্তী রায় পুনর্বিবেচনার আবেদন করেন। তাঁদের মধ্যে ছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা, সাবেক সরকারী কর্মকর্তা এবং নাগরিক সংগঠনের প্রতিনিধিরা। বিএনপির মহাসচিব ও বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেলও পৃথকভাবে রিভিউ আবেদন করেন।
২১ অক্টোবর শুরু হওয়া আপিলের শুনানি টানা ১০ দিন চলে। বিভিন্ন পক্ষের আইনজীবীরা সংবিধান, নির্বাচনী ব্যবস্থা, জনগণের ভোটাধিকার, নির্বাচন পরিচালনার নিরপেক্ষতা এবং পূর্ববর্তী আদালতের রায়ের ব্যাখ্যা নিয়ে বিস্তৃত যুক্তি উপস্থাপন করেন। রাষ্ট্রপক্ষও দেশীয় প্রেক্ষাপট, পূর্ববর্তী সিদ্ধান্ত এবং সাংবিধানিক আইন অনুযায়ী নানা দিক তুলে ধরে। শুনানি শেষে ২০ নভেম্বর রায় ঘোষণার দিন ধার্য করা হয়।
রায়ে আদালত উল্লেখ করেন, ভোটারদের আস্থা, নির্বাচন পরিচালনার নিরপেক্ষতা ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা পুনর্বহাল করা জরুরি। আদালত জানায়, পূর্ববর্তী রায়ে ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল ঘোষণা করার সময় কিছু সাংবিধানিক ব্যাখ্যা ও প্রক্রিয়াগত বিষয় যথাযথভাবে বিবেচনায় আসেনি। ফলে সংবিধানের মূল চেতনা, গণতন্ত্রের ধারাবাহিকতা ও জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে সংশোধনীকে কার্যকর করা প্রয়োজন।
রায়ের ফলে আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হলেও ভবিষ্যতে নির্বাচনের ধরন ও প্রশাসনিক কাঠামোয় বড় পরিবর্তন আসবে। বিশেষত চতুর্দশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা কার্যকর হলে রাজনৈতিক দলগুলোর নির্বাচনকালীন সমতা, নির্বিঘ্ন ভোটাধিকার নিশ্চিতকরণ এবং নির্বাচন কমিশনের কার্যক্রমে নতুন মাত্রা যোগ হবে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন। তবে এ ব্যবস্থার বাস্তবায়ন, প্রশাসনিক প্রস্তুতি ও আইনি কাঠামো আগামীর রাজনৈতিক আলোচনার কেন্দ্রে থাকবে।
দীর্ঘ ২৫ বছরেরও বেশি সময় ধরে চলমান আইনি লড়াই ও রাজনৈতিক বিতর্কের অবসান ঘটিয়ে আপিল বিভাগের এ রায় বাংলাদেশের নির্বাচনী ব্যবস্থায় নতুন অধ্যায় সূচনা করল। এখন দেশের রাজনৈতিক অঙ্গন, নাগরিক সমাজ এবং প্রশাসনিক কাঠামো—সবক্ষেত্রে রায়ের প্রয়োগ ও বাস্তবায়ন নিয়ে নতুন করে আলোচনা শুরু হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।


