আন্তর্জাতিক ডেস্ক
সংযুক্ত আরব আমিরাতের বাণিজ্যিক কেন্দ্র দুবাইয়ে চলছে বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ আন্তর্জাতিক এভিয়েশন প্রদর্শনী ‘দুবাই এয়ার শো’-এর ১৯তম আসর। পাঁচ দিনব্যাপী এই আয়োজনে বৈশ্বিক বিমান শিল্পের শীর্ষ প্রতিষ্ঠান, বেসামরিক ও সামরিক প্রতিনিধিদল এবং এভিয়েশন খাতের বিশেষজ্ঞরা একত্র হয়েছেন। গত ১৭ নভেম্বর সোমবার শুরু হওয়া প্রদর্শনী ২১ নভেম্বর শুক্রবার পর্যন্ত চলবে। আয়োজকদের মতে, অংশগ্রহণ ও প্রদর্শনের ব্যাপকতা এ বছরের আসরকে এভিয়েশন খাতের গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক প্ল্যাটফর্মে পরিণত করেছে।
দুবাই ওয়ার্ল্ড সেন্ট্রালের বিস্তৃত প্রাঙ্গণে অনুষ্ঠিত এ আয়োজন এবার ১ হাজার ৫০০-র বেশি প্রতিষ্ঠানকে একত্র করেছে। অংশ নিচ্ছে প্রায় দেড় লাখ দর্শক, বিনিয়োগকারী, উদ্যোক্তা ও গবেষকসহ বিশ্বজুড়ে এভিয়েশন খাতের সংশ্লিষ্টরা। এতে অংশ নিয়েছে ১১৫ দেশের মোট ৪৯০ জন সামরিক ও বেসামরিক প্রতিনিধি, যা আন্তর্জাতিক সহযোগিতা ও সামরিক-নাগরিক উড়োজাহাজ প্রযুক্তির পারস্পরিক অগ্রগতিতে নতুন মাত্রা যোগ করেছে।
এ বছরের প্রদর্শনীতে ২১টি দেশের প্যাভিলিয়ন স্থান পেয়েছে। এর মধ্যে প্রথমবারের মতো মরক্কোর অংশগ্রহণ বিশেষ গুরুত্ব পেয়েছে, যা মধ্যপ্রাচ্য-কেন্দ্রিক এই অনুষ্ঠানে আফ্রিকান অঞ্চলের প্রযুক্তিগত সক্ষমতা ও শিল্প-সহযোগিতার নতুন সম্ভাবনার ইঙ্গিত দিচ্ছে। আয়োজকদের তথ্য অনুযায়ী, প্রদর্শনীতে ৯৮টি কর্পোরেট প্রতিষ্ঠান তাদের সাম্প্রতিক উদ্ভাবন দেখাচ্ছে, পাশাপাশি রয়েছে ১২০টি নতুন প্রকল্পের প্রদর্শন। এসব প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে অর্ধ শতাধিক বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান, যা ভবিষ্যতের এভিয়েশন বাজারে নতুন প্রযুক্তি ও পণ্য উন্নয়নের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
এয়ার শোতে উপস্থিত আছেন এয়ারবাস ও বোয়িংয়ের মতো বৈশ্বিক নির্মাতা প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ নির্বাহীরা। অংশগ্রহণকারী কোম্পানিগুলোর মধ্যে নতুন উড়োজাহাজ কেনা ও বহর সম্প্রসারণ সংক্রান্ত বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ ঘোষণা এসেছে। ফ্লাই দুবাই তাদের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় বিস্তারের অংশ হিসেবে ১৫০টি নতুন এয়ারবাস কেনার ঘোষণা দিয়েছে। অন্যদিকে এমিরেটস জানিয়েছে, তারা আরও ৬৫টি বোয়িং ট্রিপল সেভেন যুক্ত করবে, যার আনুমানিক ব্যয় প্রায় ৩৮ বিলিয়ন ডলার। এই দুই বৃহৎ অর্ডার মধ্যপ্রাচ্যের আকাশ পরিবহন বাজারের দ্রুত সম্প্রসারণ এবং আন্তর্জাতিক রুটে প্রতিযোগিতা বৃদ্ধির ইঙ্গিত দিচ্ছে।
প্রদর্শনীতে সামরিক ও বেসামরিক উভয় ধরনের উড়োজাহাজ এবং সংশ্লিষ্ট প্রযুক্তির বিস্তৃত সমাহার দেখা যাচ্ছে। সর্বাধুনিক বিমান, হেলিকপ্টার, ড্রোন, আকাশট্যাক্সি, এমনকি উড়ুক্কু স্কুটারের মতো উদ্ভাবনী যানও এতে প্রদর্শিত হচ্ছে। এসব যানের নকশায় ব্যবহৃত হয়েছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, উন্নত উপকরণ এবং স্বয়ংক্রিয় নিয়ন্ত্রণ প্রযুক্তি, যা ভবিষ্যতে বৈশ্বিক আকাশপথকে আরও নিরাপদ, দ্রুত ও পরিবেশবান্ধব করে তুলতে পারে।
নগর-ভিত্তিক আকাশ যোগাযোগ বা ‘আরবান এয়ার মোবিলিটি’ নিয়ে এবারের প্রদর্শনীতে বিশেষ আগ্রহ লক্ষ্য করা যাচ্ছে। বিভিন্ন কোম্পানি শহরের যানজট নিরসনে আকাশট্যাক্সি, কার্গো ড্রোন ও স্বয়ংক্রিয় উড়োজাহাজের প্রোটোটাইপ তুলে ধরছে। এসব প্রযুক্তির সফল ব্যবহার চলাচলের গতি বাড়ানোর পাশাপাশি জরুরি সেবা, লজিস্টিকস ও পর্যটন খাতেও নতুন সুযোগ তৈরি করতে পারে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এসব যান ভবিষ্যতের স্মার্ট সিটি গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
এয়ার শোতে সামরিক প্রযুক্তির উপস্থিতিও উল্লেখযোগ্য। উন্নত যুদ্ধবিমান, নজরদারি ড্রোন, প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাপনা সরঞ্জাম এবং সাইবার-নিরাপত্তা প্রযুক্তির প্রদর্শন বিশ্বব্যাপী প্রতিরক্ষা সহযোগিতা জোরদারে নতুন মাত্রা যোগ করছে। বিভিন্ন দেশ নিজেদের সামরিক সক্ষমতা বাড়াতে সম্ভাব্য সহযোগিতার ক্ষেত্র খুঁজছে, যা ভবিষ্যতে আঞ্চলিক নিরাপত্তা কাঠামোতে প্রভাব ফেলতে পারে।
বেসামরিক এভিয়েশন খাতে পরিবেশবান্ধব জ্বালানির ব্যবহার, কার্বন নিঃসরণ কমানো, টেকসই উড়োজাহাজ নির্মাণ এবং যাত্রীসেবা উন্নত করার উদ্যোগও এবারের প্রদর্শনীতে আলোচনার কেন্দ্রে রয়েছে। বৈশ্বিক উড়োজাহাজ চলাচল দ্রুত বেড়ে যাওয়ায় বিমান নির্মাতা প্রতিষ্ঠান ও এয়ারলাইনগুলো পরিবেশগত প্রভাব কমানোর জন্য নতুন সমাধান তুলে ধরছে। হাইড্রোজেনচালিত ইঞ্জিন, বৈদ্যুতিক বিমান এবং হাইব্রিড প্রযুক্তির ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা নিয়েও আলোচনা হচ্ছে।
দুবাইয়ের অবস্থান এবং সরকারি-বেসরকারি বিনিয়োগের বিস্তারের কারণে শহরটি ইতোমধ্যে বৈশ্বিক এভিয়েশন কেন্দ্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। এবারের এয়ার শোতে উন্নত প্রযুক্তির ব্যাপক উপস্থিতি, উচ্চপর্যায়ের বিনিয়োগ ঘোষণা এবং প্রায় শতাধিক দেশের প্রতিনিধিদের অংশগ্রহণ ইঙ্গিত করছে যে মধ্যপ্রাচ্য—বিশেষত দুবাই—আগামী দশকে আন্তর্জাতিক বিমান চলাচল, প্রযুক্তি উদ্ভাবন এবং প্রতিরক্ষা সহযোগিতার অন্যতম কেন্দ্র হয়ে উঠতে পারে।
সব মিলিয়ে, দুবাই এয়ার শো শুধু একটি প্রদর্শনী নয়; এটি বৈশ্বিক এভিয়েশন শিল্পের অগ্রগতি, বাজার প্রসারণ, কৌশলগত অংশীদারত্ব এবং নতুন প্রযুক্তিগত দিগন্ত উন্মোচনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ মঞ্চ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে।


