ঢাকার নগরায়ন কাঠামো ভূমিকম্পের বড় ধরনের ধাক্কা সহ্য করার মতো সক্ষম নয়

ঢাকার নগরায়ন কাঠামো ভূমিকম্পের বড় ধরনের ধাক্কা সহ্য করার মতো সক্ষম নয়

 

জাতীয় ডেস্ক

রাজধানী ঢাকার বর্তমান নগরায়ন কাঠামো ভূমিকম্পের বড় ধরনের ধাক্কা সহ্য করার মতো সক্ষম নয় বলে সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করেছেন। নগরীতে দীর্ঘদিন ধরে চলমান অনুমোদনহীন ভবন নির্মাণ, জাতীয় ভবন নির্মাণ কোড অনুসরণ না করা এবং অপরিকল্পিত জনবসতি বিস্তারের কারণে ভূমিকম্প হলে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির সম্ভাবনা রয়েছে। এ অবস্থায় দ্রুত প্রয়োজনীয় নীতি বাস্তবায়ন ও ভবন নিরাপত্তা যাচাইয়ের ওপর জোর দিয়েছেন পরিকল্পনাবিদরা।

রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) আরবান রেজিলিয়েন্স প্রকল্পের আওতায় পরিচালিত সাম্প্রতিক এক জরিপে দেখা গেছে, ঢাকায় ২১ লাখেরও বেশি ভবন রয়েছে। জরিপে উল্লেখ করা হয়েছে, নিকটবর্তী মধুপুর ফল্টে ৬.৯ মাত্রার ভূমিকম্প হলে রাজধানীতে কয়েক লাখ ভবন ধসে পড়তে পারে। অধিকাংশ ভবন নির্মাণে জাতীয় বিল্ডিং কোড অনুসরণ করা হয়নি এবং প্রায় ৯৫ শতাংশ ভবন অনুমোদিত নকশার বাইরে তৈরি হয়েছে বলে জরিপে উঠে এসেছে।

এ বছর রাজউক প্রায় সাড়ে তিন হাজার অবৈধ ভবন চিহ্নিত করেছে এবং সেগুলোর বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করছে। রাজধানীর বসিলা, ঢাকা উদ্যান, কেরানীগঞ্জসহ বিভিন্ন এলাকায় কোনো অনুমোদন ছাড়াই বিপুলসংখ্যক ভবন গড়ে ওঠার বিষয়টিও নজরে এসেছে। ডিটেইল্ড এরিয়া প্ল্যানের (ড্যাপ) তথ্য অনুযায়ী, ২০০৬ থেকে ২০১৬ সালের মধ্যে প্রতি বছর গড়ে প্রায় ৯৫ হাজার ভবন নির্মিত হলেও সেগুলোর মাত্র চার হাজারের মতো ছিল অনুমোদিত। ফলে দীর্ঘ সময় ধরে অনিয়ন্ত্রিত নির্মাণশৈলী রাজধানীর ঝুঁকি বাড়িয়েছে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, ঢাকা বিশ্বের অন্যতম ঘনবসতিপূর্ণ শহর হওয়ায় এখানে ভূমিকম্পজনিত ঝুঁকি বহুগুণ বেশি। পরিকল্পনাহীন বহুতল ভবন, বস্তি, সরু সড়ক এবং দুর্বল মাটির গঠন এই ঝুঁকি আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। দেশের বড় অংশের মাটি পলিমাটি হওয়ায় শক্ত কম্পনে তা তরলীকৃত হয়ে ভবনধসের সম্ভাবনা সৃষ্টি করতে পারে।

ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের আওতাধীন ভবনগুলোর ওপর পরিচালিত মূল্যায়নে দেখা গেছে, বেশিরভাগ ভবনই ২০ থেকে ৩০ বছর আগে নির্মিত। কোথাও নির্মাণসামগ্রীর মান নিয়ন্ত্রণ হয়নি, কোথাও অনুমোদিত নকশা অনুসরণ করা হয়নি। এর ফলে মাঝারি মাত্রার ভূমিকম্পেও এসব ভবন ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

সম্প্রতি ৫.৭ মাত্রার ভূমিকম্পে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার অন্তত ১৪টি ভবন ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ঢাকার মালিবাগ, আরমানিটোলা, সূত্রাপুর, বনানী, কলাবাগান, বসুন্ধরা, নর্দ্দা, খিলগাঁও, বনশ্রী, বাড্ডা, মোহাম্মদপুর এবং বিমানবন্দর এলাকার কয়েকটি ভবনে ফাটল দেখা দেয়।

নগর পরিকল্পনাবিদদের মতে, রাজধানীতে ভবন নিরাপত্তা যাচাই ও ঝুঁকি নিরূপণের জন্য প্রয়োজনীয় জনবল ও যন্ত্রপাতি রাজউকের নেই। অনুমোদনহীন ভবনের সুনির্দিষ্ট সংখ্যা কিংবা খাল-নদীবিল দখল করে গড়ে ওঠা ভবন সম্পর্কে তথ্যও অস্পষ্ট। ফলে বিপুলসংখ্যক ঝুঁকিপূর্ণ ভবন অপসারণ বা সংস্কারের কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করা কঠিন হয়ে পড়েছে।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, সাম্প্রতিক ভূমিকম্পটি বৃহত্তর ভূমিকম্পের পূর্বাভাস হতে পারে। ৭ মাত্রার ভূমিকম্প হলে রাজধানীতে ব্যাপক ক্ষতি, ভবনধস ও প্রাণহানি ঘটতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা আরো জানান, ঢাকার আশপাশের এলাকায় অতীতে বড় মাত্রার ভূমিকম্প নথিবদ্ধ হয়েছে, যা ভবিষ্যৎ ঝুঁকি বাড়িয়ে দিচ্ছে।

রাজউকের সাবেক প্রকল্প পরিচালকরা জানান, ঢাকার ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা শনাক্ত করতে মাটির গুণগতমান পরীক্ষা করে একটি রিস্ক সেনসিটিভ ল্যান্ড ইউজ প্ল্যান প্রস্তুত করা হয়েছে। ভূমিকম্প সহনীয়তা যাচাইয়ের জন্য পৃথক প্রতিষ্ঠান গঠনের প্রক্রিয়ার কথাও জানানো হয়। তবে কার্যকর তদারকি, রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত না হলে এসব পরিকল্পনা বাস্তবায়ন কঠিন হবে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন।

নগর পরিকল্পনাবিদদের সুপারিশ অনুযায়ী, জরুরি ভিত্তিতে জাতীয় বিল্ডিং কোড কঠোরভাবে প্রয়োগ, অনুমোদনহীন ভবনের তালিকা প্রকাশ, ঝুঁকিপূর্ণ ভবন উচ্ছেদ, নিম্নাঞ্চলে নির্মাণ নিষিদ্ধকরণ এবং জলাধার ও পানি ধারণক্ষমতা সম্পন্ন এলাকা ভরাট বন্ধের ব্যবস্থা গ্রহণ প্রয়োজন। পাশাপাশি নতুন ভবনে অনুমোদিত নকশা ও কাঠামোগত মানদণ্ড অনুসরণ বাধ্যতামূলক করার ওপর জোর দেওয়া হয়েছে।

রাজধারীর নীতিমালা সংশোধন ও নতুন ইমারত বিধিমালা প্রণয়নের মাধ্যমে ভবন নির্মাণে স্বচ্ছতা ও নিয়ন্ত্রণ বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। সংশোধিত পরিকল্পনায় ঢাকার ব্লকসংখ্যা পুনর্বিন্যাস, ভবনের উচ্চতা বৃদ্ধির সুযোগ, বর্ধিত জনঘনত্ব ও নতুন শর্ত যোগ করা হয়েছে। সিউয়ারেজ ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট স্থাপন, অকুপ্যান্সি সার্টিফিকেটের নতুন নিয়ম এবং অনুমোদন প্রক্রিয়ায় পরিবর্তন আনার বিষয়গুলোও আলোচনায় রয়েছে।

ইতিহাস পর্যালোচনায় দেখা গেছে, ঢাকার আশপাশে গত দুই শতকের বেশি সময় ধরে একাধিক বড় ভূমিকম্প হয়েছে। এর মধ্যে মধুপুর ফল্ট, মানিকগঞ্জ ও নারায়ণগঞ্জ অঞ্চলে শক্তিশালী ভূমিকম্পের নথি রয়েছে। সর্বশেষ মধ্যম মাত্রার ভূমিকম্পটি ঢাকার নিকটবর্তী নরসিংদীর মাধবদীতে উৎপন্ন হয়, যা আবারও ঝুঁকির বিষয়টি স্পষ্ট করেছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভূমিকম্প প্রতিরোধ করা সম্ভব না হলেও ঝুঁকি কমানো এবং সম্ভাব্য ক্ষতি হ্রাস করা সম্ভব। এর জন্য প্রয়োজন সময়মতো কার্যকর নীতি বাস্তবায়ন, ভবন নিরাপত্তা যাচাই এবং নগর পরিকল্পনা কঠোরভাবে অনুসরণ।

বাংলাদেশ শীর্ষ সংবাদ