ইসরায়েলের বিমান হামলায় বৈরুতে হিজবুল্লাহর শীর্ষ কমান্ডার নিহত

ইসরায়েলের বিমান হামলায় বৈরুতে হিজবুল্লাহর শীর্ষ কমান্ডার নিহত

 

আন্তর্জাতিক ডেস্ক

লেবাননের রাজধানী বৈরুতের দক্ষিণাঞ্চলে ইসরায়েলি বিমান হামলায় হিজবুল্লাহর শীর্ষ সামরিক কমান্ডার হায়সম আলী তাবাতাবাই নিহত হয়েছেন। রবিবার দক্ষিণ বৈরুতের দাহিয়েহ এলাকায় হিজবুল্লাহ নিয়ন্ত্রিত একটি অ্যাপার্টমেন্ট ভবনে এই হামলা চালানো হয়, যাতে আরও কয়েকজন নিহত ও অন্তত ২৮ জন আহত হন। সাম্প্রতিক সময়ের উত্তেজনাকর পরিস্থিতির মধ্যে এই ঘটনা অঞ্চলজুড়ে নতুন করে সংঘাতের ঝুঁকি বাড়িয়ে দিয়েছে।

হামলার পর হিজবুল্লাহর পক্ষ থেকে এক বিবৃতির মাধ্যমে তাবাতাবাইয়ের মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়। তিনি সংগঠনের সশস্ত্র শাখায় দীর্ঘদিন দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন। যদিও বিবৃতিতে তার আনুষ্ঠানিক পদ বিস্তারিতভাবে উল্লেখ করা হয়নি, তাকে সংগঠনের গুরুত্বপূর্ণ সামরিক কমান্ডার হিসেবে বিবেচনা করা হতো। লেবাননের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, হামলায় আহতদের বেশ কয়েকজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক, ফলে হতাহতের সংখ্যা আরও বাড়তে পারে।

ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী দাবি করেছে, তারা তাবাতাবাইকে লক্ষ্য করেই হামলা চালিয়েছে এবং তাকে “নিষ্ক্রিয়” করা হয়েছে। ইসরায়েলের পক্ষ থেকে জানানো হয়, এই অভিযান ছিল পূর্বপরিকল্পিত এবং তাবাতাবাইকে দীর্ঘদিন ধরে লক্ষ্যবস্তু হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছিল। বিভিন্ন সূত্রের বরাতে জানা যায়, গত বছরের সংঘাতের পর থেকে এটি ছিল তার বিরুদ্ধে তৃতীয় হত্যাচেষ্টা। এই ঘটনার মাধ্যমে ইসরায়েল হিজবুল্লাহর সামরিক কাঠামোয় বড় ধরনের আঘাত হানল বলে মনে করা হচ্ছে।

হিজবুল্লাহর জ্যেষ্ঠ সদস্য মাহমুদ ক্বোমাতি এক বক্তব্যে বলেন, দক্ষিণ বৈরুতের এই হামলা “রেড লাইন” অতিক্রম করেছে এবং পরিস্থিতি অত্যন্ত জটিল পর্যায়ে পৌঁছেছে। তার মতে, হামলার ফলে লেবাননের বিভিন্ন এলাকায় উত্তেজনা বাড়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। তবে সংগঠনটির প্রতিক্রিয়া কী হবে—তা নিয়ে তারা এখনো আনুষ্ঠানিক সিদ্ধান্ত জানায়নি। সংগঠনটি পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে পরবর্তী অবস্থান ঠিক করবে বলে তিনি জানান।

হামলার পর পড়শি দেশগুলোর সীমান্তাঞ্চলেও সতর্কতা জোরদার করা হয়েছে। বিশেষ করে লেবানন-ইসরায়েল সীমান্তে নিরাপত্তা পরিস্থিতি আরও নাজুক হয়ে ওঠার শঙ্কা রয়েছে। গত কয়েক মাস ধরে সীমান্তবর্তী এলাকায় উভয়পক্ষের গোলাবিনিময় ও অস্থিরতা অব্যাহত রয়েছে। নতুন এই হামলা সীমান্ত পরিস্থিতিকে আরও অনিশ্চিত করে তুলতে পারে।

হায়সম আলী তাবাতাবাই ১৯৬৮ সালে বৈরুতে জন্মগ্রহণ করেন। তার মা লেবানিজ ও বাবা ইরানি ছিলেন। তিনি দক্ষিণ লেবাননে বড় হন এবং মাত্র ১২ বছর বয়সে হিজবুল্লাহতে যোগ দেন। দীর্ঘ চার দশকেরও বেশি সময় ধরে তিনি সংগঠনের বিভিন্ন শাখায় দায়িত্ব পালন করেন এবং অভিজ্ঞ সামরিক কমান্ডার হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। তার নেতৃত্বে হিজবুল্লাহর বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ সামরিক অভিযানে ভূমিকা রাখার ইতিহাস রয়েছে।

হামলার ফলে বৈরুতের হারেত হ্রেইক এলাকার আল-আরিদ স্ট্রিটে অবস্থিত ভবনটি ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। দুটি ক্ষেপণাস্ত্র ওই এলাকায় আঘাত হানে বলে স্থানীয় নিরাপত্তা সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন। ভবনের পাশাপাশি আশপাশের গাড়ি, পার্কিং এলাকা এবং অন্যান্য স্থাপনাতেও উল্লেখযোগ্য ক্ষতি হয়েছে। উদ্ধারকাজ পরিচালনার জন্য নিরাপত্তা বাহিনী ও জরুরি সেবাকর্মীরা ঘটনাস্থলে কাজ করেন এবং আহতদের দ্রুত হাসপাতালে স্থানান্তর করেন।

বিশ্লেষকদের মতে, এই হামলার পর হিজবুল্লাহ কঠিন কৌশলগত চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। একদিকে প্রতিক্রিয়া জানানো হলে আরও বড় মাত্রার সংঘাতের উদ্ভব হতে পারে, অন্যদিকে প্রতিক্রিয়া না জানালে সংগঠনের অস্তিত্ব ও প্রতিরোধ কাঠামো দুর্বল হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে। ইসরায়েলের সাম্প্রতিক সামরিক তৎপরতার প্রেক্ষাপটে উভয়পক্ষের উত্তেজনা নতুনভাবে বৃদ্ধি পাওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে।

এলাকাবাসী ও স্থানীয় বিশ্লেষকদের আশঙ্কা, বৈরুতের ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় এমন হামলা যদি অব্যাহত থাকে, তবে মানবিক পরিস্থিতিরও অবনতি ঘটতে পারে। ইসরায়েল ও হিজবুল্লাহর মধ্যে সম্ভাব্য নতুন সংঘাতের প্রভাব লেবাননের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতেও প্রতিফলিত হতে পারে। ইতোমধ্যে দেশটি অর্থনৈতিক সংকটে বিপর্যস্ত অবস্থায় রয়েছে, যার ওপর নতুন নিরাপত্তাজনিত সঙ্কট যুক্ত হলে তা সামগ্রিক অস্থিতিশীলতা বাড়াতে পারে।

অঞ্চলজুড়ে চলমান উত্তেজনার মাঝে এই হামলা মধ্যপ্রাচ্যের বৃহত্তর ভূরাজনৈতিক পরিস্থিতিকেও প্রভাবিত করতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। পর্যবেক্ষকদের মতে, এ ধরনের লক্ষ্যভিত্তিক হামলা পারস্পরিক প্রতিশোধমূলক কার্যক্রমের চক্র সৃষ্টি করতে পারে, যা যে কোনো সময় বিস্তৃত সংঘাতে রূপ নিতে পারে।

আন্তর্জাতিক