জাতীয় ডেস্ক
পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেছেন, সরকারের বর্তমান মেয়াদে বাকি দুই থেকে আড়াই মাসের মধ্যেই একটি কার্যকর ও দৃষ্টান্তমূলক উদ্যোগ বাস্তবায়নের লক্ষ্য রয়েছে। তিনি জানান, বিচারপ্রার্থীদের দ্রুত ও সহজসাধ্য বিচার পাওয়ার সুযোগ নিশ্চিত করতে ই-পারিবারিক আদালত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। সোমবার সকালে ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালত প্রাঙ্গণে ই-পারিবারিক আদালতের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে তিনি এই বক্তব্য দেন।
অনুষ্ঠানে উপদেষ্টা বলেন, ই-পারিবারিক আদালতের মাধ্যমে দেশের বিচারব্যবস্থা কাগজবিহীন প্রক্রিয়ার দিকে এক ধাপ এগিয়ে গেল। এ ব্যবস্থার ফলে পারিবারিক মামলাসমূহ ডিজিটালভাবে পরিচালিত হবে, যা বিচারপ্রার্থীদের সময়, ব্যয় এবং স্বাচ্ছন্দ্য—তিন ক্ষেত্রেই গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন আনবে। তিনি জানান, বিশেষ করে নির্যাতন ও সহিংসতার শিকার নারী ও শিশুদের জন্য এই আদালত নতুন সম্ভাবনা ও সুরক্ষা নিয়ে আসতে পারে, কারণ তারা দূরবর্তী স্থান বা প্রতিকূল পরিবেশ থেকেও অনলাইনে মামলা দায়ের ও প্রক্রিয়া অনুসরণের সুযোগ পাবেন।
তিনি বলেন, দেশে বিভিন্ন সেবা অনলাইনভিত্তিক হলেও বাস্তবে অনেক সেবাগ্রহীতা অনলাইনে আবেদন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে পারেন না। এ কারণে নতুন এই আদালত ডিজিটাল সেবা ব্যবস্থাকে আরও কার্যকর ও ব্যবহারবান্ধব করার পথ তৈরি করবে। অনুষ্ঠানে তিনি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে ই-পারিবারিক আদালতের সার্ভার সবসময় সচল রাখা এবং কোনো ধরনের প্রযুক্তিগত জটিলতা যাতে বিচারপ্রক্রিয়াকে ব্যাহত না করে, সে বিষয়ে বিশেষ নজরদারি করার আহ্বান জানান।
উপদেষ্টা আরও উল্লেখ করেন, দেশের বিভিন্ন উন্নয়ন ও পরিবেশবান্ধব উদ্যোগ বাস্তবায়নে প্রায়ই বাধার মুখে পড়তে হয়। তিনি বলেন, ইটভাটা বন্ধ বা স্থানান্তরের মতো পরিবেশগত সুরক্ষাবিষয়ক সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের চেষ্টা করলে তাৎক্ষণিক বাধা সৃষ্টি হয়। একইভাবে যেকোনো সংস্কারমূলক বা আধুনিকায়নমূলক উদ্যোগ নিতেও বিভিন্ন পর্যায়ে প্রতিবন্ধকতা দেখা দেয়। তবে ই-পারিবারিক আদালতের মতো উদ্যোগ এসব প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম করে কার্যকর প্রশাসনিক ব্যবস্থা গড়ে তোলার ক্ষেত্রে ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন।
ই-পারিবারিক আদালত চালুর ফলে দেশের বিচারব্যবস্থায় যে পরিবর্তন আসতে পারে, তা নিয়ে সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, ডিজিটাল প্রক্রিয়া মামলার নিষ্পত্তির হার বৃদ্ধি করবে। বর্তমানে পারিবারিক আদালতের মামলাগুলো অনেক ক্ষেত্রে দীর্ঘসূত্রতার কারণে বছর ধরে ঝুলে থাকে। অনলাইনভিত্তিক নথি ব্যবস্থাপনা, শুনানির সময়সূচি নির্ধারণ এবং প্রমাণাদি জমাদান প্রক্রিয়া স্বয়ংক্রিয়ভাবে পরিচালিত হলে এসব মামলা দ্রুত নিষ্পত্তির সম্ভাবনা বাড়বে। পাশাপাশি বিচারপ্রার্থীর শারীরিক উপস্থিতি ছাড়াই অনেক ধাপ সম্পন্ন করা গেলে আদালত প্রাঙ্গণে ভিড় কমবে এবং আদালত ব্যবস্থার ওপর চাপও হ্রাস পাবে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, ই-পারিবারিক আদালত বাস্তবায়নের মাধ্যমে দেশের আদালত ব্যবস্থায় ডিজিটাল রূপান্তরের একটি নতুন অধ্যায় শুরু হলো। এর ফলে প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে বিচারিক কার্যক্রমকে স্বচ্ছতা, গতি ও দক্ষতার নতুন ধারায় নিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে। বিশেষ করে গ্রামীণ ও দূরবর্তী অঞ্চলের নারী, শিশু ও পরিবারভিত্তিক মামলার আবেদনকারীরা দীর্ঘ পথ পাড়ি না দিয়েই সেবা পাওয়ার সুযোগ পাবেন, যা বিচারপ্রাপ্তির সমতার ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে।
অন্যদিকে, এই উদ্যোগ সঠিকভাবে পরিচালনা করতে প্রয়োজনীয় অবকাঠামো ও প্রযুক্তিগত সক্ষমতা উন্নয়নের বিষয়েও গুরুত্ব আরোপ করা হয়। সার্ভার স্থিতিশীলতা, তথ্য নিরাপত্তা, কর্মীদের প্রশিক্ষণ এবং ব্যবহারকারীদের সচেতনতা বৃদ্ধি—এই চারটি বিষয়কে বিশেষভাবে চিহ্নিত করা হয়েছে। কারণ, অনলাইনভিত্তিক বিচারব্যবস্থায় যেকোনো প্রযুক্তিগত দুর্বলতা বিচারপ্রক্রিয়ায় ব্যাঘাত সৃষ্টি করতে পারে এবং মামলার অগ্রগতিকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে। তাই সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে সার্বক্ষণিক পর্যবেক্ষণ ও রক্ষণাবেক্ষণের ওপর গুরুত্ব দেওয়ার আহ্বান জানানো হয়।
অনুষ্ঠানে বক্তারা বলেন, বিশ্বব্যাপী প্রযুক্তিনির্ভর বিচারপ্রক্রিয়া ধাপে ধাপে বিস্তৃত হচ্ছে। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতেও অনলাইন শুনানি ও ডিজিটাল নথি ব্যবস্থাপনা কার্যক্রম বৃদ্ধি পাচ্ছে। বাংলাদেশের ই-পারিবারিক আদালত চালুর উদ্যোগ এই বৈশ্বিক প্রবণতার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ এবং দেশের বিচারব্যবস্থাকে আধুনিক করার আরেকটি পদক্ষেপ। ভবিষ্যতে অন্যান্য আদালতেও এমন ব্যবস্থা ধীরে ধীরে সম্প্রসারিত হলে সামগ্রিক আদালত ব্যবস্থার গতিশীলতা বাড়বে বলে অভিমত দেওয়া হয়।
সপ্তাহের প্রথম কর্মদিবসে আয়োজিত এই উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বিচার বিভাগ, প্রশাসন ও আইটি–সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। তাঁরা ই-পারিবারিক আদালতের মাধ্যমে বিচারপ্রার্থীদের জন্য একটি সেবাবান্ধব, স্বচ্ছ ও সহজপ্রাপ্য প্রক্রিয়া নিশ্চিত হবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন। উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান জানান, সরকারের অবশিষ্ট মেয়াদে এ ধরনের উদ্যোগ বাস্তবায়ন করাই বর্তমান প্রশাসনের অন্যতম অগ্রাধিকার। তিনি বলেন, প্রযুক্তিনির্ভর একটি টেকসই বিচারব্যবস্থা গড়ে তুলতে সকলের সমন্বিত প্রচেষ্টা জরুরি, যা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি কার্যকর দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে।


