আন্তর্জাতিক ডেস্ক
দীর্ঘ দুই বছরেরও বেশি সময় ধরে গাজার ওপর ইসরাইলের অব্যাহত সামরিক অভিযান সেখানে ভয়াবহ মানবিক সঙ্কট সৃষ্টি করেছে। নিরবচ্ছিন্ন হামলায় হাজারো মানুষের মৃত্যু, হাজারো আহত এবং অসংখ্য ঘরবাড়ি ধ্বংস হওয়ায় পরিবারহীন হয়ে পড়ছে বহু শিশু। সাম্প্রতিক এক ভিডিওচিত্রে এমন কয়েকজন শিশুর বর্ণনায় উঠে এসেছে যুদ্ধক্ষেত্রে পরিবার হারানোর মর্মান্তিক অভিজ্ঞতা।
ভিডিওটিতে দেখা যায়, গাজার বিভিন্ন এলাকা থেকে আসা কয়েকজন শিশু এক ব্যক্তির প্রশ্নের জবাবে নিজেদের পরিবারের করুণ অবস্থা বর্ণনা করছে। প্রশ্নের শুরুতেই একজন ছেলেশিশু জানায়, তার বাবা-মা দুজনই আর বেঁচে নেই। হামলার এক পর্যায়ে তারা নিহত হন। তার পাশে থাকা আরেক শিশুর দিক নির্দেশ করে সে জানায়, সেও তার বাবাকে হারিয়েছে। এভাবে যুদ্ধের প্রতিদিনের বাস্তবতা তাদের কাছে পরিণত হয়েছে গভীর অনিশ্চয়তা ও নিঃসঙ্গতার প্রতীকে।
প্রশ্নোত্তরের এক পর্যায়ে পাশের আরেক শিশুকে জিজ্ঞেস করা হলে সে জানায়, তার বাবা নয়, বরং মা হামলায় নিহত হয়েছেন। শিশুটির ভাষায়, তার মা ঘর ধ্বংস হওয়ার সময়ই মারা যান। অন্যদিকে মেয়েশিশুটি জানায়, তার বাবা নাবলুস অঞ্চলে নিহত হয়েছেন। পরিবারে খাদ্যসংকট দেখা দেওয়ায় তিনি বাইরে গিয়েছিলেন খাবারের উপকরণ জোগাড় করতে। কিন্তু সেই যাত্রা আর জীবিত অবস্থায় শেষ করতে পারেননি।
ছেলেটি জানায়, তার বাবা ঘরে খাবারের জন্য আটা কিনে আনতে বের হয়েছিলেন। হামলা শুরু হলে তিনি আর ফিরে আসেননি। প্রশ্নকারী নিশ্চিত হতে চাইলে শিশুটি মাথা নেড়ে জানান দেয়, তার বাবা নিহত হয়েছেন। নিজের বাবার প্রসঙ্গ তুলতেই শিশুটির মুখে স্পষ্ট হয়ে ওঠে গভীর বেদনা ও শোকের ছাপ, যা গাজার হাজারো শিশুর আবেগ ও বাস্তব পরিস্থিতিকেই প্রতিফলিত করে।
অন্য এক মেয়েশিশু জানায়, তার বাবাকে ইসরাইলি বাহিনীর গুলিতে হত্যা করা হয়েছিল। শিশুটি বলে, তার বাবাকে তিনটি গুলি করা হয় এবং তিনি ঘটনাস্থলেই মারা যান। ছেলেটি নিজের বাবার মৃত্যুর বর্ণনা দিতে গিয়ে জানায়, বুকে গুলি ছুঁড়ে হত্যা করা হয় তাকে। তাদের পরিবারের পরিচয় সম্পর্কে জানতে চাইলে শিশুরা জানায়, তারা ‘ওদা’ পরিবারের সদস্য এবং বর্তমানে জেইতুন এলাকায় অস্থায়ীভাবে বসবাস করছে। ঘরবাড়ি ধ্বংস হওয়ায় তারা নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে আশ্রয় খুঁজে বেড়াচ্ছে।
পরবর্তী সময়ে মেয়েটি জানায়, তার বাবার নাম ছিল ফাদি। তিনি নাবলুস এলাকায় কাঠ সংগ্রহ করতে গিয়েছিলেন। ওই কাঠ বিক্রি করে পরিবারের জন্য খাবার কেনাই ছিল তার দৈনন্দিন সংগ্রামের অংশ। কিন্তু সেদিনের হামলায় তিনি আর বাড়ি ফিরতে পারেননি। পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম সদস্যকে হারিয়ে শিশুটির পরিবার আরও গভীর অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়ে গেছে।
গাজায় চলমান সংঘাতের ফলে শিশুদের ওপর যে ভয়াবহ প্রভাব পড়ছে, এই ধরনের বর্ণনা তার বাস্তব ও নির্মম প্রতিচ্ছবি। যুদ্ধের চাপ, খাদ্যসংকট, চিকিৎসাসেবার ঘাটতি এবং নিরাপদ আশ্রয়ের অভাব—এসব মিলিয়ে শিশুরা প্রতিদিন নতুন নতুন বিপদের মুখোমুখি হচ্ছে। বহু শিশু এতটাই অল্প বয়সে বাবা-মাকে হারিয়েছে যে, তারা এখনও পুরোপুরি বুঝে উঠতে পারে না ঠিক কী ঘটেছে বা তারা কী হারিয়েছে। মানসিক আঘাত দীর্ঘমেয়াদে তাদের বেড়ে ওঠা, শিক্ষা এবং সামাজিক জীবনে গুরুতর প্রভাব ফেলতে পারে বলে মানবাধিকার সংগঠনগুলো সতর্ক করেছে।
দীর্ঘমেয়াদি সংঘাতের কারণে গাজার অবকাঠামো, শিক্ষা ব্যবস্থা ও স্বাস্থ্যসেবা বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, শিশুদের শারীরিক ও মানসিক নিরাপত্তা নিশ্চিত না হলে পুরো অঞ্চলটির একটি প্রজন্ম ঝুঁকির মুখে পড়বে। পরিবার হারানো শিশুদের পুনর্বাসন, শিক্ষা ও মানসিক স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে আন্তর্জাতিক সহায়তার প্রয়োজনীয়তা দিন দিন আরও বাড়ছে।
গাজায় যুদ্ধের প্রভাবে সৃষ্ট মানবিক সঙ্কটের ভবিষ্যৎ কী হবে তা এখনো স্পষ্ট নয়। তবে পরিবারহীন হয়ে পড়া শিশুদের বর্ণনা ইঙ্গিত দেয়—এই যুদ্ধ শুধু বর্তমান নয়, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের ওপরও গভীর ক্ষত তৈরি করে যাচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে যুদ্ধবিরতি, নিরাপদ মানবিক করিডর এবং বেসামরিক নাগরিকদের সুরক্ষা নিশ্চিত করাই হতে পারে একটি স্থায়ী সমাধানের প্রথম ধাপ।


