চট্টগ্রাম বন্দরে এনসিটি ইজারা চুক্তির প্রতিবাদে শ্রমিকদের অবরোধ

চট্টগ্রাম বন্দরে এনসিটি ইজারা চুক্তির প্রতিবাদে শ্রমিকদের অবরোধ

রাজনীতি ডেস্ক

চট্টগ্রাম বন্দরের নিউমুরিং কন্টেইনার টার্মিনাল (এনসিটি) ডিপি ওয়ার্ল্ডের কাছে ইজারা দেওয়ার উদ্যোগের অভিযোগ তুলে শ্রমিক কর্মচারী ঐক্য পরিষদ (স্কপ) নেতাদের আহ্বানে বন্দর প্রবেশপথে অবরোধ কর্মসূচি পালিত হচ্ছে। বুধবার সকাল ১০টা থেকে নগরীর মাইলের মাথা, টোল রোডের টোলপ্লাজা গেট এবং বড়পুল–এই তিনটি পয়েন্টে অবরোধ শুরু হয়, যা দুপুর ১টা পর্যন্ত চলার কথা।

বন্দর-সম্পর্কিত কৌশলগত স্থাপনা বিদেশি প্রতিষ্ঠানের কাছে হস্তান্তরের সম্ভাব্য প্রক্রিয়া নিয়ে চলমান উদ্বেগের প্রেক্ষাপটে শ্রমিক সংগঠনগুলো এই কর্মসূচি ঘোষণা করে। সংগঠনের নেতারা জানান, এনসিটি ছাড়াও লালদিয়ার চর ও পানগাঁও টার্মিনাল ইজারা চুক্তি বাতিলের দাবি দীর্ঘদিন ধরে জানানো হলেও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে কোনো ইতিবাচক পদক্ষেপ দেখা যায়নি।

স্কপ নেতারা অভিযোগ করেন, সম্প্রতি লালদিয়ার চর ও পানগাঁও টার্মিনাল ইজারা দেওয়ার সময় সংশ্লিষ্ট দপ্তরের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা এনসিটি সম্পর্কিত চুক্তি খুব দ্রুত সম্পন্ন হবে বলে মন্তব্য করেন। শ্রমিক নেতাদের দাবি, অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব নির্বাচন পরিচালনা; কৌশলগত প্রকৃতি ও দীর্ঘমেয়াদি প্রভাবসম্পন্ন কোনো ইজারা চুক্তি করার নৈতিক বা আইনি অধিকার তাদের নেই। তারা উল্লেখ করেন, দেশের অর্থনৈতিক নিরাপত্তা ও বন্দর পরিচালনার সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে এমন সিদ্ধান্ত যথেষ্ট গুরুত্বের দাবি রাখে এবং এ ধরনের চুক্তি সম্পর্কে স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে সুস্পষ্ট আলোচনাও জরুরি।

কর্মসূচিতে অংশ নেওয়া শ্রমিক নেতারা জানান, চট্টগ্রাম বন্দর দেশের আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রমের প্রধান ভিত্তি হিসেবে অর্থনীতির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাদের মতে, এনসিটি বহু বছর ধরে লাভজনকভাবে পরিচালিত হচ্ছে এবং বিদ্যমান সক্ষমতা ও আয় বিবেচনায় এটি বিদেশি কোনো প্রতিষ্ঠানের কাছে হস্তান্তরের প্রয়োজন নেই। বন্দরকে ‘জাতীয় সম্পদ’ উল্লেখ করে তারা বলেন, এ ধরনের গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো ইজারা দিলে এর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব দেশের অর্থনৈতিক স্বার্থে গুরুতর ঝুঁকি তৈরি করতে পারে।

বাংলাদেশ শ্রমিক ফেডারেশনের কেন্দ্রীয় সভাপতি এস কে খোদা তোতন বলেন, শ্রমিকরা বন্দর কার্যক্রম ব্যাহত করতে চান না; তবে প্রয়োজনে আরও কঠোর কর্মসূচি বিবেচনা করা হবে। তিনি দাবি করেন, বিদেশি প্রতিষ্ঠানের কাছে টার্মিনাল হস্তান্তরের উদ্যোগ শ্রমিকদের মধ্যে অনিশ্চয়তা তৈরি করেছে, যার ফলে কর্মপরিবেশ ও পরিচালনা কাঠামোতে পরিবর্তনের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।

অন্য এক শ্রমিক নেতা খোরশেদ আলম বলেন, এনসিটি দীর্ঘদিন ধরে লাভজনকভাবে পরিচালিত হচ্ছে এবং স্বয়ংসম্পূর্ণ স্থাপনা হিসেবে এটি দেশের অর্থনীতিতে বিশিষ্ট ভূমিকা রাখে। তিনি বলেন, আন্তর্জাতিকভাবে বন্দর ও টার্মিনাল ইজারা দেওয়ার প্রবণতা থাকলেও কোনো রাষ্ট্র সাধারণত লাভজনক স্থাপনা ইজারা দেয় না; বরং অবকাঠামোর উন্নয়ন ও পরিচালনায় স্বচ্ছ নীতিমালার ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়। তার দাবি, এই বাস্তবতায় এনসিটি ইজারার যেকোনো উদ্যোগ পুনর্বিবেচনা করা জরুরি।

ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের যুগ্ম সম্পাদক ইফতেখার কামাল জানান, পূর্বঘোষিত কর্মসূচি অনুযায়ী তিনটি প্রবেশপথে অবরোধ পরিচালিত হচ্ছে। তার ভাষ্যমতে, শ্রমিক সংগঠনগুলো শান্তিপূর্ণভাবে দাবি তুলে ধরছে এবং যেকোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা নিশ্চিত করার ওপর জোর দিচ্ছে।

এনসিটি, লালদিয়ার চর ও পানগাঁও টার্মিনাল ইজারা নিয়ে চলমান বিতর্ক সম্প্রতি আরও তীব্র হয়েছে। বছরের পর বছর ধরে এসব স্থাপনার সক্ষমতা বৃদ্ধি, পরিচালনা প্রক্রিয়া এবং ভবিষ্যৎ বিনিয়োগ পরিকল্পনা নিয়ে নানা আলোচনা থাকলেও শ্রমিক সংগঠনগুলো অভিযোগ করছে যে সিদ্ধান্ত গ্রহণের গুরুত্বপূর্ণ ধাপগুলোতে তাদের মতামত বিবেচনা করা হয়নি। তারা মনে করেন, কৌশলগত স্থাপনার ভবিষ্যৎ ব্যবস্থাপনা নিয়ে যেকোনো সিদ্ধান্তে শ্রমিক, বন্দর ব্যবহারকারী প্রতিষ্ঠান এবং সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা প্রয়োজন।

পর্যবেক্ষকদের মতে, দেশের প্রধান বন্দর সংশ্লিষ্ট যেকোনো নীতি অর্থনীতিতে সরাসরি প্রভাব ফেলে। বন্দর পরিচালনা পদ্ধতি, জাহাজ চলাচল, পণ্য খালাস, কাস্টমস কার্যক্রম এবং আন্তর্জাতিক বাণিজ্য–এসব ক্ষেত্রে সামান্য পরিবর্তনও আমদানি-রপ্তানি খরচ, লজিস্টিকস ব্যয় এবং ব্যবসায়িক পরিবেশকে প্রভাবিত করতে পারে। শ্রমিক সংগঠনগুলোর দাবি—কোনো ইজারা চুক্তি হলে এসব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি হতে পারে, যা বন্দর কার্যক্রমের সার্বিক দক্ষতা ও আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতামূলক অবস্থানকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে।

শ্রমিক সংগঠনগুলো ঘোষণা করেছে, আগামীতে এই দাবিগুলো নিয়ে আরও কর্মসূচি দেওয়া হতে পারে। তবে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এখনো এ বিষয়ে কোনো আনুষ্ঠানিক মন্তব্য করেনি। পরিস্থিতি শান্তিপূর্ণ থাকলেও বন্দর এলাকায় নিরাপত্তা ও যানবাহন চলাচলে কিছুটা চাপ সৃষ্টি হয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়।

বন্দর পরিচালনা ও ইজারা সংক্রান্ত আলোচনার ভবিষ্যৎ দিকনির্দেশনা নির্ভর করবে সরকারের সিদ্ধান্ত এবং সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর আলোচনার ওপর। শ্রমিক সংগঠনগুলো দাবি আদায়ে অনড় অবস্থান বজায় রাখলেও তারা আলোচনার জন্য দরজা খোলা রাখার কথাও জানিয়েছে।

রাজনীতি সারাদেশ