আন্তর্জাতিক ডেস্ক
ক্ষমতাচ্যুত বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে দেশে ফেরত পাঠানোর বিষয়ে ঢাকা থেকে পাঠানো আনুষ্ঠানিক অনুরোধ পর্যালোচনা করছে ভারত। বুধবার নয়া দিল্লিতে আয়োজিত নিয়মিত এক সংবাদ ব্রিফিংয়ে দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রণধীর জয়সওয়াল এ তথ্য জানান। সাম্প্রতিক রাজনৈতিক পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে এই অনুরোধকে দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক কূটনীতির ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে।
ব্রিফিংয়ে মুখপাত্র জানান, বাংলাদেশ সরকার সম্প্রতি শেখ হাসিনাকে প্রত্যর্পণের জন্য তাদের কাছে নতুন একটি অনুরোধ পাঠিয়েছে। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে তাঁর বিরুদ্ধে মৃত্যুদণ্ড ঘোষণার পর এই অনুরোধ পাঠানো হয় বলে তিনি উল্লেখ করেন। ভারতের পক্ষ থেকে বিষয়টি নিয়মিত প্রক্রিয়া অনুযায়ী পর্যালোচনা করা হচ্ছে এবং সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলো এ বিষয়ে অভ্যন্তরীণ মূল্যায়ন শুরু করেছে।
শেখ হাসিনা ২০২৪ সালের আগস্ট থেকে ভারতে অবস্থান করছেন। তারও আগে, গত বছরের জুলাই মাসে ছাত্র-জনতার নেতৃত্বে সংগঠিত ব্যাপক বিক্ষোভ ও সহিংসতার মুখে তিনি বাংলাদেশ ত্যাগ করেন। রাজনৈতিক অস্থিরতা, ক্ষমতা পরিবর্তনের ধারাবাহিকতা এবং নিরাপত্তাজনিত বিবেচনায় তিনি প্রতিবেশী দেশে আশ্রয় নেন বলে জানা যায়। তখন থেকে তিনি ভারতের একটি অজ্ঞাত স্থানে অবস্থান করছেন এবং তাঁর নিরাপত্তা ও অবস্থান সংক্রান্ত তথ্য আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করা হয়নি।
বাংলাদেশ সরকার এর আগে দু’দফায় অনানুষ্ঠানিকভাবে তাঁকে ফেরত চেয়ে যোগাযোগ করেছিল। তবে আনুষ্ঠানিকভাবে চিঠি পাওয়ার বিষয়টি এবার প্রথমবার স্বীকার করেছে ভারতীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। কূটনৈতিক নিয়ম অনুসারে প্রত্যর্পণ প্রক্রিয়ায় সাধারণত আইনগত কাঠামো, দুই দেশের মধ্যে বিদ্যমান চুক্তি, মানবাধিকার পরিস্থিতি, মামলার প্রকৃতি ও সম্ভাব্য রাজনৈতিক প্রভাবসহ একাধিক দিক পর্যালোচনা করা হয়। ফলে এ ধরনের অনুরোধ নিষ্পত্তিতে সময় লাগতে পারে বলে সংশ্লিষ্ট মহল মনে করছে।
ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে প্রত্যর্পণ সংক্রান্ত একটি চুক্তি রয়েছে, যা দুই দেশের নাগরিক কিংবা অপরাধী হিসেবে বিবেচিত ব্যক্তিদের এক দেশ থেকে অন্য দেশে হস্তান্তরের প্রক্রিয়া নির্ধারণ করে। তবে চুক্তির আওতায় প্রত্যর্পণ সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে আদালতের রায়, বিচারিক প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা, অভিযুক্তের নিরাপত্তা, মানবাধিকারের সুরক্ষা ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মামলার সম্ভাবনা গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা হয়। শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে ঘোষিত দণ্ড এবং তার পটভূমি এসব মূল্যায়নে বিশেষ গুরুত্ব পাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
এ বিষয়ে ভারত এখনো কোনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত জানায়নি। মুখপাত্রের বিবৃতিতে বলা হয়, অনুরোধটি পাওয়া গেছে এবং তা প্রক্রিয়াধীন। তবে সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে দেশটির সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলো পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করবে এবং তা ভারতীয় আইনের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ কিনা তা পর্যবেক্ষণ করবে। দক্ষিণ এশীয় কূটনীতিতে এমন সিদ্ধান্ত শুধু দুই দেশের সম্পর্কেই প্রভাব ফেলে না; আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা ও রাজনৈতিক গতিবিধিতেও এর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব থাকতে পারে।
বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং ক্ষমতা পরিবর্তনের পরবর্তী পরিস্থিতি এই প্রত্যর্পণ অনুরোধকে আরও গুরুত্বপূর্ণ করে তুলেছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকের মতে, কোনো সাবেক প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে মৃত্যুদণ্ডের রায় এবং তাঁর বহির্গমন–পরবর্তী অবস্থান দক্ষিণ এশিয়ার কূটনীতিতে একটি বিরল ঘটনা। ফলে এই বিষয়টি দুই দেশের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক, ভবিষ্যৎ সহযোগিতা, নিরাপত্তা কাঠামো এবং আঞ্চলিক রাজনীতিতে প্রভাব ফেলতে পারে।
এদিকে, শেখ হাসিনার অবস্থান, তাঁর নিরাপত্তা এবং সম্ভাব্য প্রত্যাবর্তন নিয়ে বাংলাদেশে আলোচনা অব্যাহত রয়েছে। দেশটির রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং আইনি প্রক্রিয়ার ভবিষ্যৎ গতিপথ নির্ভর করবে প্রত্যর্পণ অনুরোধের বাস্তবায়ন ও সংশ্লিষ্ট সিদ্ধান্তের ওপর। ভারতীয় পররাষ্ট্র দপ্তর সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে বিভিন্ন দিক থেকে তথ্য সংগ্রহ ও মূল্যায়ন করবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। দুই দেশের সম্পর্ক অতীতের বিভিন্ন পর্যায়ে সহযোগিতা, সীমান্ত নিরাপত্তা, বাণিজ্য ও আঞ্চলিক সংহতির ওপর নির্ভর করে গড়ে উঠেছে; ফলে এই সিদ্ধান্ত ভবিষ্যৎ অংশীদারিত্বেও প্রতিফলিত হতে পারে।
প্রত্যর্পণ প্রক্রিয়ার পরবর্তী ধাপ সম্পর্কে ভারত কোনো নির্দিষ্ট সময়সীমা জানায়নি। তবে বিষয়টি যে কূটনৈতিক গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা হচ্ছে, তা মুখপাত্রের বক্তব্য থেকেই পরিষ্কার। পরিস্থিতি মূল্যায়ন শেষে এক বা একাধিক সরকারি সংস্থা যৌথভাবে সিদ্ধান্ত নেবে বলে ধারণা করা হচ্ছে, যা দুই দেশের সম্পর্কের ভবিষ্যৎ গতিপথেও প্রভাব ফেলতে পারে।


