অর্থনীতি ডেস্ক
চলতি বছরের নভেম্বরের প্রথম ২৪ দিনে প্রবাসী বাংলাদেশিদের পাঠানো রেমিট্যান্সে উল্লেখযোগ্য প্রবৃদ্ধি রেকর্ড হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ তথ্যে জানা গেছে, এ সময়ে দেশে এসেছে ২ দশমিক ৩৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ২৮ হাজার ৬৭০ কোটি টাকার সমান। গত বছরের একই সময়ের তুলনায় রেমিট্যান্স প্রবাহে উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধি লক্ষ্য করা যাচ্ছে, এবং মাস শেষে এই অঙ্ক ৩ বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করতে পারে বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে।
নভেম্বরের প্রথম তিন সপ্তাহ পেরুতেই রেমিট্যান্সের এই উচ্চমাত্রার প্রবাহ অর্থনীতিতে ইতিবাচক বার্তা দিচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রের তথ্য অনুযায়ী, গত বছরের একই সময়ে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স ছিল ১৮৪ কোটি ডলার; চলতি বছর একই সময়ে তা দাঁড়িয়েছে ২৩৫ কোটি ডলার। তুলনামূলকভাবে এ বছর প্রবৃদ্ধি হয়েছে প্রায় ৫১ কোটি ডলার। প্রতি ডলার ১২২ টাকা হিসেবে এ সময়ে গড়ে প্রতিদিন দেশে এসেছে ৯ কোটি ৭৯ লাখ ডলার, যার আর্থিক মূল্য প্রায় ১ হাজার ১৯৪ কোটি টাকা।
রেমিট্যান্স প্রবাহের এই ধারা সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ওপর উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলছে। করোনোত্তর সময়ে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দা, আন্তর্জাতিক বাজারে ডলারের অস্থিরতা এবং দেশের আমদানি ব্যয় বৃদ্ধির ফলে রিজার্ভের ওপর চাপ তৈরি হলেও রেমিট্যান্সের বর্তমান বৃদ্ধি বৈদেশিক মুদ্রার সরবরাহে নতুন স্বস্তি এনে দিচ্ছে। বছরের শুরুতে রেমিট্যান্সে মন্থরতা দেখা গেলেও গত কয়েক মাসে ধারাবাহিক ঊর্ধ্বগতি অর্থনীতির জন্য ইতিবাচক হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
অর্থনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, বৈধ চ্যানেলে প্রবাসী আয়ের প্রবাহ বৃদ্ধি পাওয়ার অন্যতম কারণ হলো প্রণোদনার হার বৃদ্ধি, ব্যাংকিং চ্যানেলে অর্থ পাঠানোর সুযোগ সহজ করা এবং বৈদেশিক মুদ্রা লেনদেনে নিয়ন্ত্রক সংস্থার নজরদারি জোরদার করা। এছাড়া বিভিন্ন দেশে অবস্থানরত প্রবাসীদের জন্য এক্সচেঞ্জ হাউস ও মানি ট্রান্সফার প্রতিষ্ঠানের সক্রিয়তা বেড়ে যাওয়ায় রেমিট্যান্স পাঠানো আরও দ্রুত ও নির্ভরযোগ্য হয়েছে। এসব কারণে প্রবাসীরা অনানুষ্ঠানিক চ্যানেলের পরিবর্তে বৈধ হুন্ডি-বহির্ভূত উপায়ে অর্থ পাঠাতে আগ্রহী হচ্ছেন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানান, রেমিট্যান্সকে আরও টেকসই ও স্থিতিশীল রাখার জন্য প্রণোদনা অব্যাহত রাখার পাশাপাশি বৈদেশিক কর্মসংস্থানে নতুন সুযোগ তৈরির প্রতি গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। বর্তমানে মধ্যপ্রাচ্য, মালয়েশিয়া ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশে কর্মসংস্থানের সুযোগ বাড়ছে। এসব বাজারে শ্রমিক প্রেরণে গতি বজায় থাকলে আগামী মাসগুলোতেও রেমিট্যান্স প্রবাহ শক্তিশালী থাকতে পারে।
রেমিট্যান্সকে দেশের অর্থনীতির অন্যতম প্রধান শক্তি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। জাতীয় আয়, বাণিজ্য ঘাটতি, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ও ব্যাংকিং খাতে রেমিট্যান্স গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রেমিট্যান্স প্রবাহের এই বৃদ্ধি টাকার বিনিময় হার স্থিতিশীল রাখতে, আমদানি ব্যয় নির্বাহে ও উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে সহায়তা করবে। একই সঙ্গে বৈদেশিক ঋণ পরিশোধ ও চলতি হিসাব ঘাটতি কমাতেও এটি কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে।
তবে রেমিট্যান্সের ওপর দীর্ঘমেয়াদি নির্ভরশীলতা সম্পর্কে নীতিনির্ধারকদের সতর্ক থাকতে পরামর্শ দিচ্ছেন অনেক অর্থনীতিবিদ। তাদের মতে, বৈদেশিক কর্মসংস্থানের বাজার সম্প্রসারণ ও দক্ষ শ্রমশক্তি গড়ে তুললে রেমিট্যান্স আরও স্থিতিশীল হতে পারে। পাশাপাশি অভ্যন্তরীণ কর্মসংস্থান বৃদ্ধির মাধ্যমে দীর্ঘমেয়াদে উৎপাদনশীল খাত শক্তিশালী করাও জরুরি।
চলতি মাসের রেমিট্যান্স প্রবাহের বর্তমান সূচক থেকে ধারণা করা হচ্ছে, নভেম্বর শেষে এটি ৩ বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করতে পারে। গত বছর শুধু ঈদুল ফিতরকে কেন্দ্র করে এক মাসে রেমিট্যান্স ৩ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছিল। চলতি বছর নভেম্বর মাসে একই প্রবণতা দেখা দিলে এটি হবে দ্বিতীয়বারের মতো কোনো মাসে রেমিট্যান্সের এ ধরনের উচ্চ প্রবাহ।
রেমিট্যান্সের এই শক্তিশালী ধারা অব্যাহত থাকলে আগামী মাসগুলোতে দেশের সামগ্রিক অর্থনীতি কিছুটা স্বস্তির মুখ দেখবে বলে প্রত্যাশা করা হচ্ছে। বিশেষ করে চলতি হিসাবের ভারসাম্য রক্ষা, রিজার্ভ স্থিতিশীল করা এবং বৈদেশিক মুদ্রা বাজার ব্যবস্থাপনায় রেমিট্যান্সের ভূমিকা আগের তুলনায় আরও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে।


