অনলাইন ডেস্ক
বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট মাঝারি মাত্রার ভূমিকম্পে কক্সবাজারের টেকনাফ শহরসহ আশপাশের উপকূলীয় এলাকায় সামান্য কম্পন অনুভূত হয়েছে। বৃহস্পতিবার (২৭ নভেম্বর) রাত ৩টা ২৯ মিনিটে টেকনাফ থেকে প্রায় ১১৮ কিলোমিটার দূরে ভূমিকম্পটির উৎপত্তি হয়। রিখটার স্কেলে এর মাত্রা ছিল ৪। স্থানীয় সূত্র অনুযায়ী, গভীর রাতে ঘটায় অধিকাংশ মানুষ কম্পনটি অনুভব করতে পারেননি।
প্রাথমিক তথ্য অনুযায়ী, ভূমিকম্পটি স্বল্পমাত্রার হলেও এর কেন্দ্রস্থল ছিল বঙ্গোপসাগরের স্থানীয় ভূকম্পন প্রবণ অঞ্চলে। আন্তর্জাতিক ভূকম্পন পর্যবেক্ষণ সংস্থাগুলোর তথ্য থেকে জানা যায়, এ ধরনের কম্পন এই অঞ্চলের সক্রিয় ভূতাত্ত্বিক গঠনের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। এক সংস্থা ভূমিকম্পটির গভীরতার তথ্য নিশ্চিত করতে না পারলেও আরেকটি সংস্থা জানিয়েছে, কম্পনটি মাটির প্রায় ১০ কিলোমিটার গভীরে সংঘটিত হয়েছিল, যা অগভীর উৎপত্তিস্থল হিসেবে বিবেচিত। অগভীর ভূমিকম্প সাধারণত দ্রুত অনুভূত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে, তবে এই ঘটনাটি রাতের গভীরতা ও স্বল্প মাত্রার কারণে অধিক প্রভাব ফেলেনি।
এই সাম্প্রতিক কম্পনটি এমন সময়ে অনুভূত হলো যখন এক সপ্তাহ আগে দেশজুড়ে শক্তিশালী ভূমিকম্পের অভিজ্ঞতা হয়েছে। গত শুক্রবার (২১ নভেম্বর) আঘাত হানা ৫ দশমিক ৭ মাত্রার ভূমিকম্পে কয়েকটি জেলার মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হন এবং বিভিন্ন এলাকায় ভবন ও স্থাপনায় ফাটল দেখা দেয়। ওই ঘটনায় কমপক্ষে ১০ জনের মৃত্যুর তথ্য পাওয়া যায়। এরপর শনিবার দিনে দেশজুড়ে আরও তিনবার মৃদু ভূমিকম্প অনুভূত হওয়ায় ভূমিকম্প পরিস্থিতি নিয়ে জনমনে উদ্বেগ বাড়তে থাকে।
আঞ্চলিক পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, একই দিন মিয়ানমারেও কাছাকাছি সময়ে তিন দফা ভূমিকম্প হয়েছিল। বাংলাদেশ সময় সকাল ৬টা ৪১ মিনিট ও ৭টা ১৯ মিনিটে সংঘটিত এসব ভূমিকম্পের মাত্রা ছিল যথাক্রমে ৩ দশমিক ৫ ও ৩ দশমিক ৭। বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তবর্তী অঞ্চলে ভূত্বকের অস্থিরতা থাকায় এ ধরনের ধারাবাহিক কম্পন বিশেষজ্ঞদের নজরে এসেছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এই অঞ্চলটি টেকটোনিক প্লেটের সংযোগস্থলে অবস্থান করায় এখানকার ভূমিকম্প কার্যক্রম স্বাভাবিক হলেও ঘন ঘন কম্পন ঝুঁকি বৃদ্ধির ইঙ্গিতও দিতে পারে।
সাম্প্রতিক ভূমিকম্পগুলোর ধারাবাহিকতা রাজধানী ঢাকাসহ ঘনবসতিপূর্ণ এলাকার বাসিন্দাদের উদ্বেগ আরও বাড়িয়েছে। বিশেষ করে ভূমিকম্পপ্রবণ অঞ্চলের নিকটে অবস্থিত ঢাকা শহর নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে সতর্কবার্তা দিয়ে আসছেন বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে, রাজধানীর ঘনবসতি, পুরনো ভবন এবং অপরিকল্পিত নগরায়ণের কারণে শক্তিশালী ভূমিকম্পে ব্যাপক ক্ষতির আশঙ্কা রয়েছে।
রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের একটি সমীক্ষায় বলা হয়েছে, পার্শ্ববর্তী জেলা টাঙ্গাইলের মধুপুর ফল্টে যদি ৬ দশমিক ৯ মাত্রার ভূমিকম্প ঘটে, তাহলে ঢাকা শহরের প্রায় ৪০ শতাংশ ভবন ধসে পড়তে পারে। তাতে দুই লাখের বেশি মানুষের মৃত্যুঝুঁকি তৈরি হতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে। এই ফল্টলাইনটি বাংলাদেশের সক্রিয় ভূতাত্ত্বিক গঠনগুলোর একটি এবং দীর্ঘ সময় ধরে এতে উল্লেখযোগ্য কম্পন না হওয়ায় বড় ধরনের শক্তি সঞ্চিত হতে পারে বলে বিশেষজ্ঞদের ধারণা।
দেশে ভূমিকম্প মোকাবিলায় ভবন নির্মাণবিধি ও জরুরি সাড়াদান সক্ষমতা নিয়ে বিভিন্ন সময়ে আলোচনা হলেও বাস্তবায়নে এখনো অনেক ঘাটতি রয়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, জাতীয় পর্যায়ে দুর্যোগ প্রস্তুতি জোরদার করা, ভবন নির্মাণে কঠোর মান নিয়ন্ত্রণ, পুরনো ভবনগুলোর ঝুঁকি মূল্যায়ন এবং জনগণের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি অত্যন্ত জরুরি। সাম্প্রতিক কম্পনগুলো এসব বিষয় পুনর্বিবেচনা করার প্রয়োজনীয়তা আরও স্পষ্ট করেছে।
টেকনাফ উপকূলবর্তী অঞ্চলের ভূগোলগত অবস্থান এবং নিকটবর্তী প্লেট সীমানার কারণে এখানকার ভূমিকম্প কার্যক্রম নিয়মিত পর্যবেক্ষণের প্রয়োজন রয়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, ছোট মাত্রার কম্পন বড় ধরনের ভূমিকম্প প্রতিরোধে সহায়ক নয়; বরং এগুলো ভূত্বকের অস্থিতিশীলতার সংকেতও হতে পারে। তাই অঞ্চলের সিসমিক ডেটা বিশ্লেষণ, শক্তিশালী পর্যবেক্ষণ ব্যবস্থা স্থাপন এবং পর্যাপ্ত প্রস্তুতিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা জরুরি।
ভূমিকম্প ঝুঁকিপূর্ণ দেশে হিসেবে বাংলাদেশে প্রতিটি কম্পনই সতর্কবার্তা হিসেবে বিবেচিত হয়। সাম্প্রতিক ঘটনাগুলো বিদ্যমান ঝুঁকি ও প্রস্তুতির ঘাটতি স্মরণ করিয়ে দিয়েছে। তাই টেকনাফের এই ভূমিকম্পসহ সামগ্রিক ভূকম্পন পরিস্থিতি নিয়ে দেশের সংশ্লিষ্ট সব সংস্থার সমন্বিত পদক্ষেপ গ্রহণ এখন সময়ের দাবি।


