জেলা প্রতিনিধি
নেত্রকোণার কেন্দুয়া উপজেলার মাহমুদপুর গ্রামে পৈতৃক সম্পত্তি নিয়ে দীর্ঘদিনের বিরোধের জেরে শিরিনা আক্তার (৪০) নামের চার সন্তানের জননী কারাগারে রয়েছেন। গত ৩০ সেপ্টেম্বর একটি চেক ডিজঅনার মামলায় আদালত তাকে এক বছরের কারাদণ্ড দেন। মামলার বাদী হিসেবে নাম রয়েছে তার দুই বোন ও তাদের স্বামীদের। পারিবারিক সম্পত্তি নিয়ে দ্বন্দ্ব এবং পূর্বের আর্থিক লেনদেনকে কেন্দ্র করে এ মামলার উদ্ভব হয়েছে বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা ও পরিবারের সদস্যরা।
পারিবারিক সূত্রে জানা যায়, শিরিনা আক্তার কয়েক বছর আগে আর্থিক সংকটের সময় দুই বোন ও তাদের স্বামীদের কাছ থেকে দেড় লাখ টাকা ঋণ গ্রহণ করেন। ঋণ গ্রহণের সময় অভিযোগ অনুযায়ী তাকে দুটি স্বাক্ষর করা খালি চেক দিতে হয়। পরে আংশিক অর্থ পরিশোধ করলেও বাকি দুই চেকে ৪১ লাখ টাকা লিখে চেক ডিজঅনার মামলা করা হয়। মামলার ভিত্তিতে আদালতের রায় অনুযায়ী বর্তমানে তিনি কারাগারে আছেন।
শিরিনার পরিবার জানায়, মূল বিরোধের সূত্র পৈতৃক সম্পত্তির ভাগাভাগি। তাদের দাবি, শিরিনা মানসিকভাবে অসুস্থ ভাই ও বৃদ্ধা মায়ের প্রাপ্য অংশ রক্ষার চেষ্টা করায় দুই বোনের সঙ্গে সম্পত্তি নিয়ে মতবিরোধ সৃষ্টি হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে সম্পত্তি নিয়ে মতানৈক্য আর্থিক লেনদেনের জটিলতার সঙ্গে মিলিয়ে দীর্ঘমেয়াদি পারিবারিক বিরোধে রূপ নেয়।
শিরিনার অনুপস্থিতিতে পরিবারের দায়িত্ব এখন স্বামী মিল্টন মিয়ার ওপর। তিনি বিভিন্ন জায়গায় শ্রম বিক্রি করে পরিবারের চার সন্তানের ভরণপোষণ চালাচ্ছেন। তাদের বড় দুই ছেলে শারীরিকভাবে প্রতিবন্ধী হওয়ায় বিশেষ যত্নের প্রয়োজন হয়। পরিবার জানায়, চলাফেরা ও স্বাভাবিক যোগাযোগে অক্ষম দু’টি সন্তানকে নিরাপদে রাখার জন্য ঘরের বারান্দায় তালাবদ্ধ রাখতে হয়। অন্যদিকে তিন ও পাঁচ বছর বয়সী দুই কনিষ্ঠ সন্তান মায়ের অনুপস্থিতিতে স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারছে না, যা পরিবারকে আরও সংকটে ফেলেছে।
এ পরিস্থিতিতে মিল্টন মিয়া জানিয়েছেন, পরিবারের আয়-ব্যয় সামলানো, প্রতিবন্ধী দুই শিশুর দেখাশোনা ও ছোট দু’টি সন্তানের যত্ন নেওয়া—সবকিছু একা সামাল দেওয়া অত্যন্ত কঠিন হয়ে পড়েছে। ফলে শিরিনার কারাবাস পুরো পরিবারকে মারাত্মক সামাজিক ও অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের মধ্যে ফেলেছে।
স্থানীয়রা জানান, শুধু শিরিনার পরিবার নয়, এলাকায় আর্থিক লেনদেন, চড়া সুদ এবং সম্পত্তি সংক্রান্ত বিরোধকে কেন্দ্র করে একাধিক পরিবার নানা জটিলতার সম্মুখীন হচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে ঋণ গ্রহণকারীরা অভিযোগ করেন যে ঋণের বিনিময়ে স্বাক্ষর করা খালি চেক পরবর্তীতে বিপুল অঙ্কের টাকায় রূপান্তরিত করে মামলা করা হয়। ফলে অভিযোগের সত্যতা প্রমাণ, ঋণের প্রকৃত অঙ্ক যাচাই এবং ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে যথাযথ তদন্তের প্রয়োজন রয়েছে বলে ধারণা স্থানীয়দের।
শিরিনার পরিবার ও প্রতিবেশীরা জানান, সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ ও মামলার ন্যায়সঙ্গত সমাধান কামনা করছেন তারা। পরিবারটি মনে করে, আদালতে উপস্থাপিত অভিযোগের প্রকৃত সত্যতা যাচাই করা হলে বিষয়টির সঠিক বিচার নিশ্চিত করা সম্ভব হবে।
কেন্দুয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ইমদাদুল হক তালুকদার বলেন, এ ধরনের চড়া সুদের লেনদেন বা সম্পত্তি সংক্রান্ত প্রতারণা আইন অনুযায়ী অপরাধ। কেউ লিখিত অভিযোগ দিলে তদন্ত করে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। প্রশাসন বিষয়টি পর্যবেক্ষণে রাখছে বলেও তিনি জানান।
আইনগত ও সামাজিক বাস্তবতায় এ ঘটনাটি স্থানীয় পর্যায়ে পারিবারিক সম্পত্তি ব্যবস্থাপনা, আর্থিক লেনদেনের স্বচ্ছতা এবং প্রতিবন্ধী শিশুদের যত্ন—এই তিনটি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুকে সামনে নিয়ে এসেছে। বিশেষ করে পৈতৃক সম্পত্তি নিয়ে মতবিরোধের কারণে সামাজিক ও পারিবারিক সম্পর্কের অবনতি এবং বিদ্যমান আইনব্যবস্থার ওপর চাপ বাড়ছে।
শিরিনা আক্তারের মামলার নিষ্পত্তি এবং তার পরিবারের সংকট নিরসনে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন বলে মনে করছেন এলাকাবাসী। তারা চান, তদন্তে বাস্তবতা উদঘাটিত হোক এবং আইনি প্রক্রিয়া অনুযায়ী পরিবারটি ন্যায়বিচার ও প্রয়োজনীয় সহায়তা পায়। শারীরিকভাবে প্রতিবন্ধী দুই শিশুসহ চার সন্তানের দীর্ঘমেয়াদি নিরাপত্তা ও যত্ন নিশ্চিত করাও এখন জরুরি হয়ে পড়েছে।


