এশিয়ার চার দেশে ঘূর্ণিঝড়–বন্যা–ভূমিধসে প্রাণহানি ৯ শতাধিক

এশিয়ার চার দেশে ঘূর্ণিঝড়–বন্যা–ভূমিধসে প্রাণহানি ৯ শতাধিক

 

আন্তর্জাতিক ডেস্ক

এশিয়ার ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া ও শ্রীলঙ্কায় ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড়, লাগাতার বর্ষণ, বন্যা এবং ব্যাপক ভূমিধসের ফলে এ পর্যন্ত ৯০০–র বেশি মানুষের মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। গত এক সপ্তাহ থেকে ১০ দিনের মধ্যে সংঘটিত এই দুর্যোগে হাজার হাজার মানুষ গৃহহীন হয়েছেন এবং বহু মানুষ এখনো নিখোঁজ রয়েছেন। সংশ্লিষ্ট দেশের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের প্রাথমিক হিসাব অনুযায়ী, সবচেয়ে বেশি প্রাণহানি হয়েছে ইন্দোনেশিয়া ও শ্রীলঙ্কায়।

সাম্প্রতিক ভারী বর্ষণ এবং শক্তিশালী ঝড়ের প্রভাবে চার দেশে একই সঙ্গে বন্যা ও ভূমিধস দেখা দেয়, যা স্বল্প সময়ের মধ্যে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি ডেকে আনে। ইন্দোনেশিয়ায় অন্তত ৪৩৫ জনের মৃত্যু নিশ্চিত করা হয়েছে, যেখানে বিভিন্ন প্রদেশে পাহাড়ি ঢলে ভূমিধসের কারণে বহু ঘরবাড়ি মাটিচাপা পড়ে। শ্রীলঙ্কায় প্রাণহানি হয়েছে কমপক্ষে ৩৩৪ জনের; দেশটির কেন্দ্রীয় ও দক্ষিণাঞ্চলে দীর্ঘসময় ধরে প্রবল বর্ষণের ফলে নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়ে বহু গ্রাম প্লাবিত ছাড়াও সড়ক ও সেতু ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

থাইল্যান্ডে অন্তত ১৬২ জনের মৃত্যু হয়েছে বলে স্থানীয় প্রশাসনের তথ্য থেকে জানা যায়। দেশটির উত্তর ও পূর্বাঞ্চলে অস্বাভাবিক বর্ষণ এবং পাহাড়ি ঢলে শতাধিক স্থাপনা ধসে পড়েছে। মালয়েশিয়ায় প্রাণহানি তুলনামূলক কম হলেও দুজনের মৃত্যু এবং কয়েক হাজার মানুষের বাস্তুচ্যুত হওয়ার ঘটনা ঘটেছে। চার দেশ মিলিয়ে নিখোঁজের সংখ্যা কয়েকশ’ বলে ধারণা করা হচ্ছে, তবে সুনির্দিষ্ট সংখ্যা উদ্ধারকাজ শেষ না হওয়া পর্যন্ত নিশ্চিত করা সম্ভব হচ্ছে না।

দুর্যোগের কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন নিম্নাঞ্চলে বসবাসকারী ও নদী–নালা–হ্রদের তীরবর্তী অঞ্চলের মানুষ। অনেক এলাকায় সেতু, বাঁধ, সড়ক, বৈদ্যুতিক লাইন, পানি সরবরাহ ব্যবস্থা এবং কৃষিজমি ধ্বংস হয়েছে। ইন্দোনেশিয়া ও শ্রীলঙ্কার বেশ কিছু অঞ্চলে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করা হয়েছে, যাতে উদ্ধার ও ত্রাণ কার্যক্রম নির্বিঘ্নে পরিচালনা করা যায়।

চার দেশের সরকার উদ্ধারকাজে সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী এবং বিশেষ উদ্ধার দল মোতায়েন করেছে। নৌকা, হেলিকপ্টার ও বিশেষ সরঞ্জামের সাহায্যে ধ্বংসস্তূপের নিচে আটকে পড়া মানুষদের উদ্ধারের চেষ্টা চলছে। একই সঙ্গে গৃহহীন মানুষদের জন্য অস্থায়ী আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে, যেখানে খাদ্য, বিশুদ্ধ পানি, চিকিৎসা সহায়তা ও জরুরি সামগ্রী সরবরাহের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, চলতি মৌসুমে এশিয়ার বর্ষা প্রবণ অঞ্চলে অস্বাভাবিক জলবায়ুগত পরিবর্তন দেখা দিয়েছে। উষ্ণতা বৃদ্ধি এবং সমুদ্রের পৃষ্ঠতলের তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ার কারণে শক্তিশালী ঝড়ের সংখ্যা ও তীব্রতা উভয়ই বৃদ্ধি পেয়েছে। এর ফলে বৃষ্টিপাতের ধরণ পরিবর্তিত হচ্ছে, যা একদিকে স্বল্পসময়ে অতিবৃষ্টি এবং অন্যদিকে দীর্ঘকালীন শুষ্কতা—উভয় অবস্থাই সৃষ্টি করতে পারে। চার দেশে ঘটে যাওয়া দুর্যোগকে এ পরিবর্তনের একটি সাম্প্রতিক উদাহরণ হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে।

বন্যা–ভূমিধসে সৃষ্ট ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নির্ধারণে কাজ শুরু করেছে স্থানীয় প্রশাসন এবং আন্তর্জাতিক মানবিক সংস্থাগুলো। প্রাথমিক হিসাবে দেখা গেছে, ইন্দোনেশিয়া ও শ্রীলঙ্কায় বহু কৃষিজমি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় খাদ্য উৎপাদনে প্রভাব পড়তে পারে। থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়ার আক্রান্ত অঞ্চলে যোগাযোগব্যবস্থা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে আরও সময় লাগবে।

এবং, নিখোঁজদের খুঁজে পেতে উদ্ধার দলের সদস্যরা দিনরাত কাজ করছেন। প্রতিকূল আবহাওয়া উন্নত না হওয়া পর্যন্ত উদ্ধার কার্যক্রম আরও জটিল হতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। আন্তর্জাতিক মানবিক সহায়তা পাঠানোর বিষয়ে বিভিন্ন সংস্থা প্রস্তুতি নিচ্ছে, তবে দুর্যোগের এলাকাগুলোতে পৌঁছাতে কঠিন পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হচ্ছে।

চার দেশে সংঘটিত এই দুর্যোগ আবারও জলবায়ু সহনশীল অবকাঠামো নির্মাণ, আগাম সতর্কবার্তা জোরদার করা এবং দুর্যোগ প্রস্তুতি বাড়ানোর প্রয়োজনীয়তার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বর্ষা ও ঝড়প্রবণ অঞ্চলের সরকারগুলোকে যৌথভাবে দুর্যোগ মোকাবিলায় দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে, যাতে মানবিক ক্ষতি ও অবকাঠামোগত ক্ষতির পরিমাণ ভবিষ্যতে কমানো সম্ভব হয়।

আন্তর্জাতিক