বিচার বিভাগের পূর্ণ স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয় গঠনের অধ্যাদেশ জারি

বিচার বিভাগের পূর্ণ স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয় গঠনের অধ্যাদেশ জারি

 

আইন আদালত ডেস্ক

বিচার বিভাগের প্রাতিষ্ঠানিক স্বতন্ত্রীকরণকে পূর্ণতা দিতে সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয় অধ্যাদেশ, ২০২৫ জারি করা হয়েছে। রোববার (৩০ নভেম্বর) রাষ্ট্রপতির নির্দেশে আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয় অধ্যাদেশটি প্রকাশ করে। এর মাধ্যমে নির্বাহী বিভাগের সঙ্গে বিচার বিভাগের প্রশাসনিক সম্পৃক্ততা আনুষ্ঠানিকভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে বিচার বিভাগ সম্পূর্ণ স্বাধীন প্রশাসনিক কাঠামোতে প্রবেশ করল।

অধ্যাদেশ জারির মাধ্যমে সুপ্রিম কোর্টের জন্য একটি পৃথক সচিবালয় প্রতিষ্ঠার প্রক্রিয়া চূড়ান্ত রূপ পায়। এর আগে ২০ নভেম্বর অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টা পরিষদ সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয় অধ্যাদেশ, ২০২৫–এর খসড়ার চূড়ান্ত অনুমোদন দেয়। বিচার বিভাগের স্বাধীন কাঠামো গঠনের দীর্ঘদিনের দাবি এবং সংবিধানসম্মত নির্দেশনা বাস্তবায়নই ছিল এ উদ্যোগের প্রধান লক্ষ্য।

বিচার বিভাগকে নির্বাহী বিভাগ থেকে পৃথকীকরণের প্রাতিষ্ঠানিক প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করতে ২০২৪ সালের ২৭ অক্টোবর প্রধান বিচারপতির উদ্যোগে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট থেকে একটি প্রস্তাব আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। ওই প্রস্তাবে সংবিধানের ১০৯ অনুচ্ছেদ বাস্তবায়নের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরে হাইকোর্ট বিভাগের অধস্তন আদালত ও ট্রাইব্যুনালের তত্ত্বাবধান এবং নিয়ন্ত্রণ যথাযথভাবে পালনের জন্য একটি পৃথক সচিবালয় প্রতিষ্ঠার সুপারিশ করা হয়। প্রস্তাবের সঙ্গে সচিবালয়ের অর্গানোগ্রাম, রুলস অব বিজনেস এবং অ্যালোকেশন অব বিজনেসে প্রয়োজনীয় সংস্কারের বিস্তারিতও পাঠানো হয়।

অধ্যাদেশ জারির ফলে বিচার বিভাগের স্বাধীন প্রশাসনিক কাঠামো আনুষ্ঠানিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হলো। এটি বিচার বিভাগের নীতি নির্ধারণ, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনা, বাজেট পরিচালনা এবং অধস্তন আদালত তত্ত্বাবধানের ক্ষেত্রে সুপ্রিম কোর্টের ক্ষমতা আরও সুসংগঠিত ও কার্যকর করবে। বিচার বিভাগের নিজস্ব সচিবালয় প্রতিষ্ঠা দীর্ঘদিন ধরে আলোচিত ছিল; এবার সেই লক্ষ্য বাস্তব রূপ পেল।

এ অগ্রগতির পেছনে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিচারিক নির্দেশনা ভূমিকা রেখেছে। গত ২ সেপ্টেম্বর হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ অধস্তন আদালতের বিচারকদের নিয়ন্ত্রণ সম্পর্কিত সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদের সংশোধনীকে অবৈধ ঘোষণা করে বাহাত্তরের সংবিধানের মূল অনুচ্ছেদ বহাল করে। ওই রায়ের মাধ্যমে বিচারকদের কর্মস্থল নির্ধারণ, পদোন্নতি, দণ্ড, ছুটি মঞ্জুরি এবং শৃঙ্খলা বিধানের পূর্ণ দায়িত্ব সুপ্রিম কোর্টের হাতে ন্যস্ত হয়। বিচারপতি আহমেদ সোহেল ও বিচারপতি দেবাশীষ রায় চৌধুরীর সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ রায়ে উল্লেখ করেন যে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে নির্বাহী বিভাগের নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখা সংবিধান পরিপন্থী।

রায়ে সুপ্রিম কোর্ট কর্তৃপক্ষের পাঠানো প্রস্তাব অনুযায়ী তিন মাসের মধ্যে একটি পৃথক সচিবালয় প্রতিষ্ঠার নির্দেশ দেওয়া হয়। সেই বিচারিক নির্দেশনা অনুযায়ী সরকার দ্রুত প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে সংশ্লিষ্ট অধ্যাদেশ জারি করে। এর ফলে বিচার বিভাগের সাংবিধানিক কাঠামো আরও সুস্পষ্ট হয়েছে এবং আদালতের কার্যক্রমে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা বৃদ্ধির সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে।

নতুন সচিবালয় বিচার বিভাগের প্রশাসনিক কর্মকাণ্ড নিয়ন্ত্রণ করবে, যা পূর্বে মূলত নির্বাহী বিভাগ পরিচালনা করত। বিচার বিভাগকে স্বাধীন ও শক্তিশালী করার সাংবিধানিক প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে এটি একটি মাইলফলক বলে বিবেচিত হচ্ছে। পৃথক সচিবালয়ের মাধ্যমে হাইকোর্ট বিভাগ অধস্তন আদালত পরিচালনায় আরও দৃঢ় ভূমিকা পালন করতে পারবে। এর ফলে বিচারকদের প্রশাসনিক সিদ্ধান্তগ্রহণ দ্রুততর ও কার্যকর হবে, যা বিচারপ্রক্রিয়ার গতি বৃদ্ধিতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে।

নতুন কাঠামো বাস্তবায়নের পর বিচার বিভাগের বাজেট প্রণয়ন, জনবল ব্যবস্থাপনা, কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন এবং সহায়ক প্রশাসনিক সেবা পরিচালনা সরাসরি সুপ্রিম কোর্টের তত্ত্বাবধানে আসবে। এটি বিচার বিভাগের দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়ন, অবকাঠামোগত সংস্কার পরিকল্পনা এবং ডিজিটাল কার্যক্রম বাস্তবায়নেও সহায়ক হবে।

অধ্যাদেশ কার্যকর হওয়ার মাধ্যমে বিচার বিভাগের পূর্ণ স্বাধীনতা নিশ্চিত করার সাংবিধানিক লক্ষ্য আরও সুদৃঢ় হলো। ভবিষ্যতে আদালত পরিচালনা ও বিচারপ্রশাসনে এর প্রভাব পরিলক্ষিত হবে বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন।

আইন আদালত