জাতীয় ডেস্ক
চট্টগ্রাম বন্দরের নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনাল (এনসিটি) পরিচালনার জন্য বিদেশি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের চুক্তি প্রক্রিয়ার বৈধতা প্রশ্নে জারি করা রুলে হাইকোর্টের দ্বৈত বেঞ্চ ভিন্নমত পোষণ করে পৃথক রায় দিয়েছেন। বৃহস্পতিবার প্রকাশিত এই রায়ে জ্যেষ্ঠ বিচারপতি ফাতেমা নজীব চুক্তি প্রক্রিয়াটি অবৈধ বলে ঘোষণা করেন, অন্যদিকে বেঞ্চের জুনিয়র বিচারপতি ফাতেমা আনোয়ার চুক্তি প্রক্রিয়াকে বৈধ হিসেবে মতামত দেন।
বৈচিত্র্যময় রায়ের ফলে বিষয়টি এখন নিষ্পত্তির জন্য হাইকোর্টের আরেকটি বেঞ্চে পাঠানো হবে। নিয়ম অনুযায়ী প্রধান বিচারপতি নতুন বেঞ্চ গঠনের মাধ্যমে মামলার চূড়ান্ত নিষ্পত্তির ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন। ফলে এনসিটি পরিচালনা নিয়ে চলমান বিতর্ক ও আইনগত অবস্থান আরও এক দফা বিচারিক পর্যালোচনার মুখোমুখি হতে যাচ্ছে।
আদালতে রিটের পক্ষে বিভিন্ন আইনজীবী শুনানিতে অংশ নেন এবং রুলের পক্ষে যুক্তি উপস্থাপন করেন। রাষ্ট্রপক্ষ এ ক্ষেত্রে সরকারের অবস্থান তুলে ধরে চুক্তি প্রক্রিয়ার বৈধতা, বন্দর পরিচালনার কার্যকারিতা এবং সরকারি নীতিমালার আলোকে গৃহীত পদক্ষেপের যৌক্তিকতা ব্যাখ্যা করে। উভয় পক্ষের বিস্তারিত শুনানি শেষে গত ২৫ নভেম্বর আদালত রায়ের জন্য দিন নির্ধারণ করেছিলেন।
চলমান চুক্তির বৈধতা নিয়ে রুলটি জারি করা হয় গত ৩০ জুলাই। ওই রুলে প্রশ্ন তোলা হয়—চুক্তি প্রক্রিয়াটি কেন আইনগত কর্তৃত্ববহির্ভূত ঘোষণা করা হবে না। পাশাপাশি, এনসিটি পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়ার ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট আইন ও নীতিমালা অনুসরণ করে ন্যায্য ও প্রতিযোগিতামূলক দরপত্র আহ্বান নিশ্চিত করতে কেন নির্দেশ দেওয়া হবে না, তাও জানতে চাওয়া হয়। রুলটি জারি করেন বিচারপতি হাবিবুল গনি ও বিচারপতি শেখ তাহসিন আলীর যৌথ বেঞ্চ।
রিটটি করেছিলেন বাংলাদেশ যুব অর্থনীতিবিদ ফোরামের সভাপতি মির্জা ওয়ালিদ হোসাইন। তাঁর পক্ষে দাখিলকৃত রিট আবেদনে বলা হয়, দেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ বন্দর টার্মিনাল বিদেশি অপারেটরের কাছে ন্যস্ত করার ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা, ন্যায্যতা ও প্রতিযোগিতামূলক প্রক্রিয়া অনুসরণ বাধ্যতামূলক। রিট আবেদনে এ বিষয়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন সংযুক্ত করা হয়, যেখানে এনসিটি পরিচালনার সক্ষমতা, বিদ্যমান কাঠামো, প্রযুক্তি এবং জনবলসংক্রান্ত তথ্য তুলে ধরা হয়েছিল। আবেদনে আরও বলা হয়, দরপত্র আহ্বান ছাড়া বিদেশি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি করতে গেলে এটি নীতি ও বিধির সঙ্গে সাংঘর্ষিক হতে পারে এবং জনস্বার্থের বিরোধিতা সৃষ্টি করতে পারে।
প্রাসঙ্গিকভাবে উল্লেখযোগ্য যে, নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনাল চট্টগ্রাম বন্দরের অন্যতম কৌশলগত টার্মিনাল হিসেবে বিবেচিত। দেশের আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রমের একটি বড় অংশ এই টার্মিনালের মাধ্যমে পরিচালিত হয়। জট কমানো, দক্ষতা বাড়ানো এবং আন্তর্জাতিক মান বজায় রাখতে টার্মিনালের আধুনিকায়ন ও সক্ষমতা উন্নয়নের প্রয়োজনীয়তা দীর্ঘদিন ধরেই আলোচিত। বিদেশি অপারেটরের অংশগ্রহণ এসব ক্ষেত্রে কী ভূমিকা রাখতে পারে, তা নিয়েও বিভিন্ন মহলে আলোচনা রয়েছে।
তবে চুক্তি প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা এবং আইনি ন্যায্যতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠায় বিষয়টি আদালতের নজরে আসে। রিটকারী পক্ষের দাবি ছিল—এনসিটির বিদ্যমান অবকাঠামো, যন্ত্রপাতি এবং মানবসম্পদ দেশীয় ব্যবস্থাপনায় পরিচালনার জন্য যথেষ্ট। তাই কোনো বিদেশি অপারেটর নিয়োগের আগে প্রতিযোগিতামূলক দরপত্র আহ্বান করা উচিত ছিল। বিপরীতে রাষ্ট্রপক্ষ যুক্তি উপস্থাপন করে জানায়, বন্দর পরিচালনার দক্ষতা বাড়াতে আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতা বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে এবং প্রক্রিয়া সরকারের নীতিগত সিদ্ধান্তের অধীনেই চলছে।
হাইকোর্টের সংশ্লিষ্ট বেঞ্চের বিভক্ত রায় এখন বন্দরের ভবিষ্যৎ পরিচালনা কাঠামো এবং নীতি বাস্তবায়নের ওপর তাৎপর্যপূর্ণ প্রভাব ফেলতে পারে। নতুন বেঞ্চে বিষয়টি বিচারাধীন হলে চূড়ান্ত রায়ে স্পষ্ট হবে—চুক্তি প্রক্রিয়ার কোন অংশ বৈধ বা অবৈধ হিসেবে বিবেচিত হবে এবং ভবিষ্যতে সরকারি সংস্থাগুলোর বিদেশি অপারেটরের সঙ্গে চুক্তি প্রক্রিয়ায় কী ধরনের নীতিমালা অনুসরণ করতে হবে।
দেশের বন্দর ব্যবস্থাপনা, আন্তর্জাতিক বাণিজ্য প্রবাহ এবং লজিস্টিক খাতের উন্নয়ন দীর্ঘমেয়াদে যৌক্তিক নীতিনির্ধারণের ওপর নির্ভরশীল। এনসিটি পরিচালনা নিয়ে আদালতের চূড়ান্ত রায় তাই জাতীয় অর্থনীতি ও বাণিজ্য ব্যবস্থাপনার জন্য গুরুত্বপূর্ণ দিকনির্দেশক হিসেবে কাজ করতে পারে। আদালতের পরবর্তী কার্যক্রম শেষ হলে বিষয়টির পূর্ণাঙ্গ আইনগত অবস্থান স্পষ্ট হবে।


