প্রযুক্তি ডেস্ক
ভূমিকম্পের মাত্রা ও অবস্থান নির্ধারণে সিসমোগ্রাফ, সিসমোগ্রাম এবং ভূকম্পীয় তরঙ্গ বিশ্লেষণের মতো বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি কীভাবে কাজ করে, তার একটি সমন্বিত ব্যাখ্যা দিয়েছেন ভূ-কম্পন বিশেষজ্ঞরা। পৃথিবীর গভীরে অবস্থানকারী চ্যুতি বা ফাটলের আকার, সেই চ্যুতিতে শিলাস্তর কতটা সরেছে এবং এসব পরিবর্তনের ফলে উৎপন্ন তরঙ্গের প্রকৃতি ভিত্তি করেই নির্ণয় করা হয় কোনো ভূমিকম্পের শক্তি ও উৎপত্তিস্থল।
ভূমিকম্পের আকার বা ম্যাগনিচিউড নির্ভর করে মূলত দুটি বিষয়ের ওপর—চ্যুতির আকার এবং চ্যুতিতে শিলাস্তরের সরে যাওয়ার পরিমাণ। সাধারণত এই চ্যুতিগুলো ভূ-পৃষ্ঠের অনেক গভীরে হওয়ায় সরাসরি পরিমাপের সুযোগ থাকে না। তাই ভূকম্পবিদেরা ব্যবহার করেন সিসমোগ্রাফে রেকর্ড করা ভূকম্পীয় তরঙ্গের নড়াচড়া, যা সিসমোগ্রাম নামে পরিচিত। সিসমোগ্রামে রেকর্ড হওয়া রেখার দৈর্ঘ্য ও তীব্রতা দেখে বিজ্ঞানীরা ভূমিকম্পের পরিধি ও শক্তি সম্পর্কে ধারণা পান।
সিসমোগ্রামে ছোট ও কম নড়াচড়াযুক্ত রেখা সাধারণত ছোট মাত্রার ভূমিকম্পের নির্দেশ দেয়। বিপরীতে দীর্ঘ ও তীব্র নড়াচড়ার রেখা বড় মাত্রার ভূমিকম্পের ইঙ্গিত বহন করে। নড়াচড়ার দৈর্ঘ্য চ্যুতির বিস্তৃতির সাথে সম্পর্কযুক্ত, আর নড়াচড়ার তীব্রতা নির্ভর করে পিছলে যাওয়ার পরিমাণের ওপর। এভাবে চ্যুতির ভৌত আচরণই ভূমিকম্পের শক্তি সম্পর্কে ধারণা দেয়।
ভূমিকম্পের মাত্রাকে সাধারণভাবে ম্যাগনিচিউড হিসেবে উল্লেখ করা হয়, যা প্রতিটি ভূমিকম্পের জন্য একটি নির্দিষ্ট মান বহন করে। অপরদিকে ভূমিকম্পের তীব্রতা নির্ভর করে মানুষ কোথায় অবস্থান করছে তার ওপর। একই ভূমিকম্প কোনো অঞ্চলে তীব্রভাবে অনুভূত হলেও দূরবর্তী স্থানে তা অপেক্ষাকৃত দুর্বলভাবে অনুভূত হতে পারে। ফলে মাত্রা একটি নির্দিষ্ট পরিমাপ হলেও তীব্রতা স্থানভেদে পরিবর্তনশীল।
ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল নির্ধারণেও সিসমোগ্রামের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। এ ক্ষেত্রে বিজ্ঞানীরা বিশ্লেষণ করেন পি (Primary) তরঙ্গ এবং এস (Secondary) তরঙ্গের আগমনের সময়। পি তরঙ্গ দ্রুতগামী এবং এস তরঙ্গ অপেক্ষাকৃত ধীরগতির হওয়ায় দুটি তরঙ্গের আগমনের সময় ব্যবধান বিজ্ঞানীদের জানিয়ে দেয় ভূমিকম্পটি সেই সিসমোগ্রাফের অবস্থান থেকে কত দূরে ঘটেছে। উদাহরণ হিসেবে বজ্রপাত ও বজ্রধ্বনির পার্থক্যের দিকে নজর দেওয়া যায়—যেভাবে আলো শব্দের চেয়ে দ্রুত ভ্রমণ করে, তেমনি ভূমিকম্পের ক্ষেত্রে পি তরঙ্গ এস তরঙ্গের আগেই পৌঁছায়।
তবে শুধুমাত্র একটি সিসমোগ্রাফ ব্যবহার করে ভূমিকম্প কোন দিকে ঘটেছে, তা নির্ধারণ করা সম্ভব নয়। এজন্য প্রয়োজন একাধিক সিসমোগ্রাফের তথ্য। বিজ্ঞানীরা ট্রায়াঙ্গুলেশন পদ্ধতি প্রয়োগ করে তিনটি ভিন্ন সিসমোগ্রাফের তথ্য ব্যবহার করেন। প্রতিটি সিসমোগ্রাফের কেন্দ্র ধরে একটি বৃত্ত আঁকা হয়, যার ব্যাসার্ধ সেই স্টেশন থেকে ভূমিকম্প পর্যন্ত দূরত্ব। এই তিনটি বৃত্ত যেখানে ছেদ করে, সেটিই হয় ভূমিকম্পের উপকেন্দ্র।
এই পদ্ধতি শুধু ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল নির্ণয়েই নয়, ভবিষ্যতের ভূমিকম্প-সংক্রান্ত বিশ্লেষণ, ঝুঁকি মূল্যায়ন এবং দুর্যোগ প্রস্তুতিতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। সঠিক অবস্থান নির্ণয় ভূগর্ভস্থ চ্যুতিগুলোর সক্রিয়তা সম্পর্কে দীর্ঘমেয়াদি তথ্য প্রদান করে, যা ভূমিকম্প-প্রবণ অঞ্চলে নির্মাণনীতি, অবকাঠামো পরিকল্পনা এবং জরুরি সাড়া প্রদানের কৌশল নির্ধারণে সহায়তা করে।
এ ছাড়া সিসমোগ্রাফ থেকে সংগৃহীত ডেটা ভূতাত্ত্বিক গবেষণায় ব্যবহৃত হয়, যা পৃথিবীর অভ্যন্তরীণ কাঠামো, শিলাস্তরের আচরণ এবং ভূত্বকের গতিশীলতার ওপর বৈজ্ঞানিক জ্ঞান বৃদ্ধিতে অবদান রাখে। প্রতিটি বড় ভূমিকম্প পৃথিবীর অভ্যন্তরে কী ধরনের পরিবর্তন ঘটায়, কোন অঞ্চলে কতটা শক্তি সঞ্চিত হতে পারে—এসব তথ্যও দীর্ঘমেয়াদে সিসমোগ্রাফিক বিশ্লেষণের মাধ্যমে জানা যায়।
বিশেষজ্ঞদের মতে, ভূমিকম্প পূর্বাভাস এখনো নির্ভুলভাবে দেওয়া সম্ভব না হলেও, সিসমোগ্রাফিক ডেটার নিয়মিত বিশ্লেষণ ভূমিকম্পের ধরন, চ্যুতি সক্রিয়তার প্রবণতা এবং ঝুঁকিপ্রবণ অঞ্চলের চিত্র আরও স্পষ্টভাবে তুলে ধরে। এর ফলে ভূমিকম্প মোকাবিলায় প্রস্তুতিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণে সহায়তা পাওয়া যায় এবং সম্ভাব্য ক্ষয়ক্ষতি কমানো সম্ভব হয়।
ভূমিকম্প গবেষণার এ সকল পদ্ধতি পৃথিবীর অভ্যন্তরে জটিল প্রক্রিয়াগুলো বোঝার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। বিজ্ঞানীদের মতে, প্রযুক্তিগত অগ্রগতি ও উন্নত সিসমিক পর্যবেক্ষণ ভবিষ্যতে আরও সুনির্দিষ্ট বিশ্লেষণের সুযোগ তৈরি করবে, যা ভূমিকম্প-সংক্রান্ত ঝুঁকি ব্যবস্থাপনাকে আরও কার্যকর করে তুলতে পারে।


