আন্তর্জাতিক ডেস্ক
ফিলিস্তিনি সশস্ত্র সংগঠন হামাস ও ইসরায়েলের মধ্যে চলমান যুদ্ধবিরতির পরবর্তী ধাপ শিগগিরই শুরু হতে পারে বলে জানিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। চলমান উত্তেজনা, যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘন ও মানবিক পরিস্থিতি নিয়ে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে জোর আলোচনা চলার মধ্যেই তিনি এ বক্তব্য দেন।
গত ১০ অক্টোবর থেকে কার্যকর যুদ্ধবিরতি সত্ত্বেও ইসরায়েল পক্ষ ৫০০ বারের বেশি চুক্তি লঙ্ঘন করেছে বলে বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থার বরাত দিয়ে উল্লেখ করা হয়। এসব হামলায় যুদ্ধবিরতির সময়সীমায় প্রায় ৪০০ ফিলিস্তিনি নিহত হন। নিয়মিত বিমান হামলা, গোলাবর্ষণ এবং স্থল অভিযান অব্যাহত থাকায় যুদ্ধবিরতির স্থায়িত্ব বিষয়ে আন্তর্জাতিক মহলে উদ্বেগ বাড়ছে।
ট্রাম্প বুধবার (৩ ডিসেম্বর) সন্ধ্যায় এক ব্রিফিংয়ে জানান, ওইদিন খান ইউনিসে বাস্তুচ্যুত ফিলিস্তিনিদের ওপর বিমান ও কামান হামলায় অন্তত পাঁচজন নিহত হয়েছেন। ইসরায়েল দাবি করেছে, তাদের সেনাদের ওপর হামলা চালানোয় হামাস সদস্যদের লক্ষ্য করে অভিযানে এই হতাহতের ঘটনা ঘটে। তবে স্থানীয় পর্যবেক্ষকরা জানিয়েছেন, হামলার কেন্দ্রবিন্দু ছিল ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা, যেখানে বিপুলসংখ্যক বাস্তুচ্যুত মানুষের অবস্থান ছিল।
ইসরায়েলি বাহিনীর ওপর কথিত হামলার প্রসঙ্গে বক্তব্য দিতে গিয়ে ট্রাম্প বলেন, ওইদিন একটি বিস্ফোরণে কয়েকজন গুরুতর আহত হয়েছেন এবং নিহতও থাকতে পারে। তা সত্ত্বেও তিনি দাবি করেন, সামগ্রিকভাবে যুদ্ধবিরতি ‘চলমান রয়েছে’। তার ভাষ্য অনুযায়ী, মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠার প্রক্রিয়া এগিয়ে চলছে এবং যুদ্ধবিরতির দ্বিতীয় ধাপের প্রস্তুতিও অব্যাহত রয়েছে। তিনি আশা প্রকাশ করেন, এ ধাপ শিগগিরই কার্যকর হবে।
বর্তমানে হামাসের কাছে ইসরায়েলি পক্ষের দুইজন জিম্মি রয়েছে, যার মধ্যে একজন থাইল্যান্ডের নাগরিক বলে জানানো হয়েছে। জিম্মিদের ফেরত দেওয়ার পরই যুদ্ধবিরতির দ্বিতীয় ধাপ আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু করার কথা থাকলেও ইসরায়েল এ বিষয়ে বিলম্ব করছে বলে বিভিন্ন পর্যবেক্ষণ থেকে জানা গেছে। জিম্মি ইস্যুটি আলোচনার প্রধান অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে, যার কারণে যুদ্ধবিরতি বাস্তবায়নে সময়ক্ষেপণ হচ্ছে।
এদিকে, হামাস ও ইসরায়েলের মধ্যে যুদ্ধবিরতির দ্বিতীয় ধাপ সংক্রান্ত আনুষ্ঠানিক চুক্তি এখনো স্বাক্ষরিত হয়নি। তবুও যুক্তরাষ্ট্র জানিয়েছে, জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের সঙ্গে সমন্বয় করে দ্বিতীয় ধাপ বাস্তবায়নের জন্য প্রাথমিক কাঠামো বা মেকানিজম নির্ধারণ করা হয়েছে। এসব প্রস্তাবে গাজা উপত্যকার প্রশাসনিক কাঠামোতে পরিবর্তন আনার কথা বলা হয়েছে, যার আওতায় একটি টেকনোক্র্যাট সরকার শাসনের দায়িত্ব নিতে পারে। পাশাপাশি হামাসের পরিবর্তে নিরাপত্তার দায়িত্ব নেওয়ার জন্য আন্তর্জাতিক বাহিনী মোতায়েনের প্রস্তাব বিবেচনায় রয়েছে।
যুদ্ধবিরতির দ্বিতীয় ধাপের সম্ভাব্য প্রক্রিয়ার মধ্যে রয়েছে: গাজার অভ্যন্তরে মানবিক করিডর স্থাপন, আন্তর্জাতিক সাহায্য প্রবাহ বাড়ানো, জিম্মিদের মুক্তি এবং বেসামরিক মানুষের নিরাপদ বসবাস নিশ্চিত করতে নির্দিষ্ট অঞ্চলসমূহে অস্ত্রবিরতি বজায় রাখা। এই ধাপ সফলভাবে বাস্তবায়িত হলে দীর্ঘমেয়াদি রাজনৈতিক সমাধানের পথ প্রশস্ত হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
গাজায় চলমান সংঘাতের ফলে সৃষ্ট মানবিক সংকট ক্রমেই ভয়াবহ হয়ে উঠছে। আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর সাম্প্রতিক হিসাব অনুযায়ী, বাস্তুচ্যুত মানুষের সংখ্যা কয়েক লাখ ছাড়িয়েছে। খাদ্য, পানি, ওষুধ এবং আশ্রয়ের সংকট তীব্র আকার ধারণ করেছে। যুদ্ধবিরতির দ্বিতীয় ধাপ শুরু হলে এসব সংকট নিরসনে আন্তর্জাতিক সহায়তা আরো সহজ হবে বলে আশা করা হচ্ছে। তবে পরিস্থিতি স্থিতিশীল না হলে মানবিক কার্যক্রম সীমিত থাকতে পারে।
বিশ্লেষকদের মতে, যুদ্ধবিরতির দ্বিতীয় ধাপ শুরু হলেও এর দীর্ঘমেয়াদি সাফল্য নির্ভর করবে পক্ষগুলোর রাজনৈতিক সদিচ্ছা, আন্তর্জাতিক মধ্যস্থতার কার্যকারিতা এবং নিরাপত্তা পরিস্থিতির ওপর। বিশেষ করে গাজার প্রশাসনিক কাঠামোতে পরিবর্তন আনা এবং আন্তর্জাতিক বাহিনীর দায়িত্ব গ্রহণের বিষয়গুলো স্থানীয় জনগণের গ্রহণযোগ্যতা, পক্ষগুলোর সম্মতি এবং ভূরাজনৈতিক সমীকরণের সঙ্গে জড়িত।
মধ্যপ্রাচ্যের স্থিতিশীলতা পুনরুদ্ধারে যুদ্ধবিরতি একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হলেও, সংঘাতের মূল কারণ নিষ্পত্তি না হলে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠা কঠিন হয়ে পড়বে—এমন বার্তা দিয়েছেন বিভিন্ন অঞ্চলের কূটনৈতিক বিশ্লেষকরা। তবুও দ্বিতীয় ধাপের সম্ভাব্য বাস্তবায়নকে বর্তমান সংকট উত্তরণে একটি উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে।


